খানিকটা জিরিয়ে পটল উঠল। আরও একটু জিরোলে হত, কিন্তু তার কি উপায় আছে! খিচুড়িটা ঠাণ্ডা মেরে গেলেই গোবর। ঠাণ্ডা খিচুড়ি পটল দাস দু’চোখে দেখতে পারে না। আর প্যালার মা’ও তেমন ভালমানুষের মেয়ে নয় যে, ঠাণ্ডা খিচুড়ি ফের গরম করতে উনুন ধরাবে।
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে পটল দাস দেওয়ালের একটা ঘুলঘুলিতে চোখ রাখল। একরত্তি ঘুলঘুলি। ছানিপড়া চোখে বাইরের কুয়াশা আর অন্ধকারে তেমন কিছু ঠাহরও হয় না। এবার ঠাণ্ডাটাও পড়েছে বাপ। হাড় একেবারে ফালি হয়ে গেল।
গ্রিন ভ্যালির দিকটায় একটা টর্চের আলো দেখা গেল না? হ্যাঁ, তাই বটে। জ্বলছে, নিবছে। একটা লম্বাপানা লোক কী একটা বস্তু ঘাড়ে করে যেন ভাঙা পাঁচিলটা বেয়ে নামল।
সর্বনাশ! হরি ছোঁড়াটা ধরাই পড়ল নাকি? কেলেঙ্কারি আর কাকে বলে! আনাড়ি ছেলেমানুষ, একটা-দুটো কোঁতকা খেলেই ভ্যাড়ভ্যাড় করে সব বলে দেবে।
নাঃ, কপালটাই খারাপ। পটল দাস আপনমনেই মাথা নাড়ল।
তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হামাগুড়ি দিয়ে খানিকটা গিয়ে একটা বড় ঘুলঘুলির সামনে থামল। কোনওক্রমে একটা বড় বেড়াল গলে যেতে পারে এমন একটা ফোকর।
‘তা পটল দাস কুকুর বেড়ালের বেশিই বা কী? পটল খুব অভিমানভরে কথাটা বিড়বিড় করে বলল। তারপর দমটা ছেড়ে শরীরটা নরম করে পটল দাস সেই ঘুলঘুলি দিয়ে ঠিক একটা বেড়ালের মতোই গলে গেল। চোদ্দ ফুট নীচে জমি। তা হোক। পটল দাস হাওয়ায় ভর দিয়ে পাখির মতোই নেমে এল নীচে।
লম্বা লোকটা হরিকে কাঁধে নিয়ে অর্ধেক বাগান পেরিয়ে চলে এসেছে। আর দেরি করাটা ঠিক হবে না।
পটল দাস জোর কদমে কোনাকুনি গিয়ে লোকটার একখানা হাত ধরে ফেলল। তারপর অমায়িক গলায় বলল, “দেশলাই আছে বাপু তোমার কাছে? একটা বিড়ি খাব!”
লোকটা পটলকে দেখে এত অবাক হল যে তার কাঁধ থেকে হরি গড়িয়ে পড়ে গেল মাটিতে, ধপাস করে।
“তুই! তোকে কে ছেড়েছে?”
পটল একগাল হেসে বলল, “ছাড়বে কী গো? ধরল কখন? আর ধরে হবেটাই বা কী? আমার পেটে যে কথা থাকে না তা সবাই জানে। দুধের বাছারা সব কী যেন খুঁজছে, কবর না কী, ছাইমাটি। তা বাপু, আমার কবরটবর শ্মশানটশানে বড় ভয়। আমি ওসব জানিও না, চিনিও না। তা বাপু, আছে নাকি দেশলাই?”
লোকটার বিস্ময় কেটে এবার হিংস্র রাগ উঠল। বলল, “তোর অনেক চালাকি দেখেছি। ফের কোনও চালাকি করেই বেরিয়ে এসেছিস! কিন্তু এবার তোর খেলা শেষ।”
এই বলে লোকটা তার প্রকাণ্ড দুটো হাতে পটল দাসকে লৌহ-ভীম চূর্ণ করার মতো শক্ত আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরতে গেল।
পটল একটু সরে দাঁড়াল শুধু।
লোকটা দুহাতে জাপটে ধরতে গিয়ে খানিকটা বাতাস ছাড়া আর কিছু পেল না। কিন্তু এবার আর অবাক হওয়ার অবকাশটুকুও তাকে দিল না পটল। হাত বাড়িয়ে তার গাঁটওলা আঙুল দিয়ে খুব মৃদু একটু তবলা বাজিয়ে দিল তার মাথায়।
লোকটা হাঁ করা অবস্থায় মাটিতে পড়ে গেল দড়াম করে। পড়ে আর নড়ল না।
পটল অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকা লোকটার দিকে চেয়ে ভারী বিরক্তির
গলায় বলল, “দ্যাখো কাণ্ড, একেবারে ফুলের ঘায়ে মূর্ছা গেল! এই বুড়ো আঙুলে কি আর সেই ক্ষমতা আছে রে বাপ, তবু এইটুকুই সইতে পারলি না! ছ্যা ছ্যা। তোরা কী রে?”
লোকটাকে ছেড়ে পটল এবার হরির দিকে তাকাল। কাঁধ থেকে পড়েই হোক, আর হিম লেগেই হোক, হরির জ্ঞান ফিরে এসেছে। ডোম্বলের মতো চোখ পিটপিট করে চাইছিল। পটলকে দেখে উঠে বসে বলল, “ওঃ, মাথাটা ভীষণ ঝিমঝিম করছে।”
“মাথাটা যে এখনও ঘাড়ের ওপর আছে তাই ঢের। কে তোকে সুড়ঙ্গে ঢুকতে বলেছিল শুনি!”
মুখে হাত বোলাতে বোলাতে হরি একটু অবাক হয়ে পটল দাসের দিকে চেয়ে বলল, “ওরা তোমাকে ছেড়ে দিল যে বড়।”
“ছেড়ে দেবে না তো কী? ভাল লোকেদের ওইটেই সুবিধে, ঘোর পাপীরাও তাদের খাতির করে। নে, এখন ওঠ। এ-জায়গাটা এবার তোকে ছাড়তে হচ্ছে।”
“কোথায় যাব?”
পটল দাস মাথা নেড়ে বলল, “সে কি আর ভাল জায়গা রে? প্যালার মা মহাদজ্জাল, উঠতে বসতে কথা শোনাবে। তার ওপর গরিবের ঘর,
সেখানে নুন-পান্তার জোগাড়ই ভাল করে হয় না। কিন্তু এখানে তো আর টিকতে পারবি না। গ্রিন ভ্যালি বেশ বিপদের জায়গা হয়ে পড়েছে।”
হরি উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, “কিন্তু এই লোকটা সুড়ঙ্গের কথা জেনে ফেলেছে। একে ফেলে গেলে সব ফাঁস করে দেবে।”
পটল খিঁচিয়ে উঠে বলল, “খুব কেরানি দেখিয়েছ। পাজি ছোঁড়া কোথাকার! তোর জন্যই তো সব ফাঁস হল। এখন কী করা যাবে, এ তো মহা মুশকিল হল।”
হরি লজ্জিত হয়ে বলল, “কিন্তু এ-লোকটার একটা ব্যবস্থা না করে কোথাও যাওয়া ঠিক হবে না। আমি বলি কি, একে হাত-পা বেঁধে সুড়ঙ্গের মধ্যে ভরে রাখলে কেমন হয়।”
“মরে যাবে। শেষে মানুষ খুনের মামলায় পড়বি।”
“তা বটে। তা হলে?”
পটল দাস কিছুক্ষণ মাথা চুলকোতে চুলকোতে ভাবল। তারপর বলল, “খিদেটাও পেয়েছে বেজায়। ওদিকে খিচুড়িটা এতক্ষণে ঠাণ্ডা জল হয়ে গেল। তোকে বলেই বলছি। কথাটা পাঁচকান করিস না।”
কৌতূহলী হয়ে হরি বলল, “কী কথা পটলদা?”
পটল গলাটা নামিয়ে বলল, “ঠাণ্ডা খিচুড়ি কখনও খাস না। ঠাণ্ডা হলে খিচুড়িতে আর গোবরে তফাত নেই।”
“কিন্তু আমি তো বাসী খিচুড়ি খেতে খুব ভালবাসি।”
“সে আমিও বাসি।”