পটল হিসেব কষে দেখল, এখন বলতে গেলে তার পাহারাদার দু’জন হরিকে ধরে আনতে গেছে। তাকে বাদ দিলে এদের দলের আরও দু’জন আছে বটে, তবে তারা এখন বাইরের দিকটা পাহারা দিচ্ছে।
পটল দাসকে কাঁপতে দেখে বেঁটেটা বলল, “খুব শীত করছে বুঝি?”
“আজ্ঞে। খুব।”
“একটু পরেই গা গরম হয়ে যাবে। চিন্তা কোরো না।”
“আজ্ঞে তা বেশ বুঝতে পারছি। তবে খামোখাই পাপের ভাগী হচ্ছেন, আমি তেমন কিছু জানি না।”
“আমরা মেলা পাপের ভাগী হয়েই আছি। আর দু’একটা পাপ বাড়লে তেমন ক্ষতি হবে না। তবে যদি পেট খোলসা করে সব বলে দাও তা হলে আর পাপটা আমাদের করতে হয় না।”
“তা বটে। কিন্তু কথার আছেই বা কী! ওই হরি ছোঁড়ার বড় গল্প শোনার নেশা। কেবল আমাকে গল্প বলার জন্য যন্ত্রণা করে। তাই বানিয়ে বানিয়ে কী সব যেন বলছিলুম। আর সেই কথাই গদাধরভায়া বাইরে থেকে শুনে ভাবলে আমি বোধহয় গোপন কথা সব ফাঁস করছি।”
“তা আমাদের সেই বানানো গল্পটাই বলল না। শুনি একটু।”
“শুনবেন?” বলে গলা-খাঁকারি দিয়ে পটল দাস কী যেন বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ কী একটু শুনে চমকে উঠে বলল, “ও রাবা, শব্দ কিসের?”
শব্দটা এবার সকলেই শুনতে পেল। খুব কাছেপিঠে, একেবারে ঘরের মধ্যেই একট চাপা ‘ফোঁস!’
এ শব্দ সকলেরই চেনা। মোমের আলোয় মস্ত ঘরটার সিকিভাগও দেখা যাচ্ছে না। আসবাবপত্র, আনাচকানাচ সবই অন্ধকারে ডুবে আছে। এর মধ্যে সাপটা কোথায় গা-ঢাকা দিয়ে আছে কে জানে!
বেঁটে লোকটা বিদ্যুৎ-গতিতে ভোজালিটা বের করে বলে উঠল, “সাপ!”
যে লোকটা এতক্ষণ মূর্ছা গিয়ে পড়েছিল, সেই সবার আগে লাফিয়ে উঠে বলল, “বাপ রে বাপ!”।
চোখের পলকে বাকিরাও গায়ের ব্যথা ভুলে উঠে দাঁড়াল। এবার বেশ জোরালো শব্দ হল, “ফোঁস! ফোঁস! ফোঁস!” গায়ের আলোয়ানটা ফেলে দিয়ে পটল দাস লাফিয়ে উঠে বলল, “ওরে বাবা রে! গেছি রে! আলোয়ানের মধ্যে ঢুকেছে রে বাপ!”
মুহূর্তে একটা হট্টগোল পাকিয়ে উঠল। ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি।
পটল দাস আলোয়ানটা তুলে ঝাড়া দিয়ে বলে উঠল, “ওই যে, ওই যে!”
সঙ্গে-সঙ্গে সাপের তীব্র শিসে ঘর ভরে গেল। বেঁটে আর তার দলবল পড়ি-কি-মরি করে ছুটল বারান্দায়।
পটল দাস খুবই ধীরস্থির ভঙ্গিতে গিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে হুড়কো তুলে দিল। মোমটা এক ছুঁয়ে নিবিয়ে দিয়ে সে অন্য পাশে ঘরের আর একটা দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে অন্ধকারেই হাতড়ে একদম তলার চৌকাঠে খুব ছোট্ট একটা পেরেকের মতো বস্তুতে চাপ দিয়ে দরজাটা ঠেলল। খুব সামান্য একটু ফাঁক হল পাল্লা দুটো। পটল দাস সেই ফাঁকের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে ভিতরে খুব সরু একটা ঝুলন্ত সুতোয় টান দিতেই পাল্লা সম্পূর্ণ খুলে গেল। ভিতরে ঢুকে পাল্লাটা বন্ধ করে সুতো ফের টেনে দিল পটল।
ওপাশে তখন ধুন্ধুমার ধাক্কা পড়ছে বাইরের দরজায়। চালাকিটা বোধহয় এতক্ষণে ধরতে পেরে গেছে বাছারা। বেচারাদের জন্য একটু দুঃখও হচ্ছিল পটলের। দুধের বাছারা, সবে এই লাইনে এসেছে, এখনও তেমন বুদ্ধি পাকেনি, কান তৈরি হয়নি, চোখের নজর জোরালো হয়নি। ওরা কি আর এইসব টোটকা চালাকি ধরতে শিখেছে। সাপের শিস শুনে বাছাদের ধাত ছাড়বার জোগাড়। পটলের ভারী ইচ্ছে করছিল, ওদের কোলের কাছে বসিয়ে আদর করে সব শিখিয়ে দেয়। সাপের ডাক, বাঘের ডাক, শেয়ালের ডাক, ঝিঁঝির শব্দ। দুনিয়ায় এখনও কত কী শেখার আছে। এদেরও একটু শেখাতে ইচ্ছে করছিল তার। তবে তার ঢের সময় পাওয়া যাবে। আগে একবার হরি ছোঁড়াটার তল্লাশ নিতে হয়। ওদিকে খিচুড়িটাও বোধহয় ঠাণ্ডা মেরে গেল। কী আর করা!
পটল দাস কোনওদিন টর্চ ব্যবহার করে না। ওসবের দরকারও হয় না। সাহেবপাড়ার বাড়িগুলোর অন্ধিসন্ধি তার জানা। সে অন্ধকারেই ঘরটা পেরিয়ে পাশের দরদালানের দিককার দরজা আবার কৌশল করে খুলে ফেলল। তারপর দরদালান পার হয়ে একটা সরুমতো প্যাসেজে ঢুকে সে দাঁড়াল। প্যাসেজটা আড়াই-তিন ফুটের বেশি চওড়া নয়।
একটু দাঁড়িয়ে দম নিয়ে নিল পটল। এবার কাজটা শক্ত। পটল দাসের কাছে শক্ত, কিন্তু অন্যদের কাছে অসম্ভব।
পটল দাস দু’দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়াল দুটো ধরল। তারপর স্রেফ হাত আর পায়ের ভর-এ তরতর করে উঠে যেতে লাগল ওপর দিকে। হাতের ভর দিয়ে পা ছাড়ে, পায়ে ভর রেখে হাত ছাড়ে। চাড় দিয়ে একবারে হাতখানেক করে ওপরে উঠে যায়।
প্রায় বারো-চোদ্দ ফুট উঁচুতে একটা অয়েলপেন্টিং টাঙানো। পটল দাস সেটার কাছ বরাবর পৌঁছে ছবিটা সরিয়ে ছোট্ট একটা গর্তের মধ্যে টিকটিকির মত সেঁধিয়ে গিয়ে ছবিটা ফের টেনে দিল।
বয়সটা বেশ হয়েছে। এইটুকু উঠতেই আজকাল বেশ হাঁফ ধরে যায়। আর হুডযুদ্বুও তো আজ কম হয়নি। ব্যাটারা কম ডলাইমলাই করেছে নাকি তাকে? তবে কিনা পাকা হাড়, ছোঁড়াগুলোর মারের হাতও তেমন তৈরি হয়নি, তাই এখনও পটল দাস খাড়া আছে। ভগবানেরই লীলা!
পটল গর্তে ঢুকে একটু জিরোল।
চোখ বুজে বুক ভরে দম নিয়ে আর ছেড়ে পটল দাস আপনমনেই একটু হাসল। হরি ছোঁড়াকে সুড়ঙ্গের পথ বাতলানো ঠিক হয়নি। ছোঁড়াটা নির্ঘাত ছবি সরিয়ে সুড়ঙ্গে ঢুকে বেমক্কা ঘুরতে ঘুরতে এবাড়িতে চলে এসেছিল।
পটল সময়মতো ‘প্যালা! প্যালা!’ করে না চেঁচালে একটা কেলেঙ্কারি হতে পারত। ছোঁড়াটা যে ছবির পিছনে দাঁড়িয়ে ঘরের সব কাণ্ড দেখছিল তাতে পটলের সন্দেহ নেই। ঘাবড়ে গিয়ে শব্দসাড়া দিয়ে ফেলতে পারত, নাকে ধুলো ঢুকে হেঁচে ফেলতে পারত, বা কেসেই ফেলল হয়তো। এমনকী দীর্ঘশ্বাস ফেলাটাও অসম্ভব ছিল না। পটল চেঁচানোয় ছোঁড়াটা বুদ্ধি করে পালিয়েছে। ছোঁড়া ধরা পড়লে সুড়ঙ্গের কথাটা জানাজানি হয়ে যেত।