হরি সামনে এসে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়ানোর পর গগনবাবু বললেন, “হরি, লেখাপড়া যা করেছিস তা তো দেখতেই পাচ্ছি। এখন বল্ তো, কোন্ সাবজেক্টটা তোর কাছে তত কঠিন বলে মনে হয় না।”
হরিবন্ধু এই প্রশ্নে খুবই ভড়কে গিয়ে অনেকক্ষণ আমতা-আমতা করে বলল, “ইয়ে, বাংলা কবিতাটা বেশ সোজা।”
“বাঃ, বাঃ, তা হলে কবিতার দিকে ঝোঁক আছে! বেশ, এবার বল্ তো, লেখাপড়া ছাড়া আর তোর কোন গুণ আছে বলে মনে হয়? সোজা কথায় তুই আর কী কী পারিস?”
হরিবন্ধু ফের আকাশ-পাতাল ভাবল, তারপর মাথা চুলকে-টুলকে বলল, “ইয়ে..বোধহয় গাছ বাইতে পারি।”
“বাঃ, বেশ। টারজান। টারজানও বেশ ভাল গাছ বাইতে পারত। তা আর কী পারিস?”
“গুলতিতে পাখি মারতে পারি।”
“বাঃ, এটাও তো গুণই ধরতে হবে। তার মানে লক্ষ্যভেদ করতে পারিস। অর্জুনের এ-গুণ ছিল, একলব্যের ছিল, কর্ণের ছিল। বাঃ, বাঃ। আর কী কী করতে ভাল লাগে তোর?”
হরি নির্দ্বিধায় বলল, “খেতে।”
গগনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “এটা খারাপ কিছু নয়। খেতে সকলেই ভালবাসে। স্যার আশুতোষও বাসতেন। আর?”
“আর? আর ঘুমোতে।” গগনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “নট ব্যাড। ঘুম জৈব ধর্ম। নেপোলিয়ন ঘোড়ার পিঠে বসে যুদ্ধ করতে করতে ঘুমোতেন। তোর পড়তে পড়তে ঘুম পেতেই পারে। আর কী ভাল লাগে তোর?”
একটু লাজুক গলায় হরি বলল, “আর স্কুল-পালাতে।”
গগনবাবু গেল বার হরিদ্বারে বেড়াতে গিয়ে একখানা কাঠের লাঠি কিনে এনেছিলেন। সেটার দিকে হাত বাড়িয়েও থেমে গিয়ে বললেন, “স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও স্কুল করতে পছন্দ করতেন না, তোর আর দোষ কী?”
হরি বিনয়-বিগলিত মুখে মাথা নিচু করে রইল। গগনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “কিন্তু এত গুণ থেকেও তো তোর কোনও উন্নতি হচ্ছে না রে হরি। আমার মনে হয়, এবাড়ির আবহাওয়ায় তোর আর উন্নতি হবেও না। তাই আমি ঠিক করেছি তোকে মোতিগঞ্জে পাঠাব। সেখানে আমার চেনা এক ভদ্রলোকের মস্ত বাড়ি আছে। সেখানে থাকবি, স্কুলটাও ভাল। কয়েক দিনের মধ্যেই যেতে হবে। তৈরি থাকিস।”
বাবা হলেন হাইকোর্ট, তাঁর ওপরে আর কথা নেই। মা-ঠাকুমা মেলা কান্নাকাটি করলেন বটে, কিন্তু হরিকে শেষ অবধি টিনের স্যুটকেস আর শতরঞ্চিতে বাঁধা বিছানা নিয়ে মোতিগঞ্জে যেতেই হল।
এইবার মোতিগঞ্জ জায়গাটার একটু বর্ণনা দেওয়া দরকার। এক কথায় এমন সুন্দর জায়গা বিরল। চারদিকে ছোটখাটো পাহাড়ের শ্ৰেণী আর শাল-মহুয়ার জঙ্গলে ঘেরা। জঙ্গলে বাঘ আছে, ভালুক আছে, হায়না এবং বুনো কুকুর আছে। আবার সৌন্দর্যও বড় কম নেই। বিভিন্ন ঋতুতে জঙ্গলের গাছে-গাছে নানারকম ফুল ফোটে। মোতিগঞ্জ ঠিক শহর নয়, ছোট একখানা গঞ্জ। তবে স্বাস্থ্যকর জায়গা বলে এখানে কলকাতার অনেক বড়লোক বাড়ি করে ফেলে রেখেছেন। সারা বছরই বলতে গেলে বাড়িগুলো খালি পড়ে থাকে। একজন মালি বা দরোয়ানের হেফাজতে। মোতিগঞ্জের কাছাকাছি একটি অভ্রখনি ছিল, সেটা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। জগবন্ধু সাহা নামে একজন বাঙালি ব্যবসাদার ওই খনি কিনে একদা প্রচুর পয়সা করেছিলেন। মানুষটির দানধ্যানের জন্য খ্যাতি ছিল। তিনিই মোতিগঞ্জের চারুবালা বেঙ্গলি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। স্কুলটি যাতে ভাল চলে, সেজন্য জগবন্ধু সাহা খুঁজে-খুঁজে ভাল-ভাল শিক্ষককে বেশি মাইনে দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। একটি চমৎকার ছাত্রাবাসও তিনি তৈরি করে দেন। নিজে ভাল লেখাপড়া জানতেন না বলে শিক্ষার প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ছিল। চারুবালা তাঁর মা। জগবন্ধু বা চারুবালা কেউই আজ আর বেঁচে নেই। তবে স্কুলটি আছে। চারুবালা বেঙ্গলি স্কুলের বৈশিষ্ট্য হল, যে-কোনও ছাত্রকেই এখানে ভর্তি করা হয়। চূড়ান্ত গবেটকেও ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। তারপর তাদের কড়া ডিসিপ্লিন ও হাড়ভাঙা খাটুনির ভিতর দিয়ে মানুষ করে দেওয়া হয়। সেখানে ফাঁকির স্থান নেই।
স্কুল থেকে আধমাইল দূরে শহরের প্রায় প্রান্তে একখানা বাগান-ঘেরা বাড়ি। বাড়িখানা পুরনো, যত্নের অভাবে রং চটে গেছে। তবে বেশ বড় বাড়ি। গগনবাবুর রুগি দুখিরামবাবু শখ করে বাড়িখানা কিনেছিলেন। মাঝে-মাঝে হাওয়া বদল করতে আসবেন বলে। এ বাড়িরই একতলার সামনের দিকে কোণের একখানা ঘরে হরির জায়গা হল। দরোয়ান থাকে গেটের পাশে ছোট্ট ঘরে। দরোয়ানের বউ আছে, দুটো ছেলে-মেয়ে আছে। বাগানখানা ভারী চমৎকার। পেয়ারা, আম, জাম, আতা, কুল, সবেদা, ফলসা, বেল কোনও গাছেরই অভাব নেই। ফুলও ফোটে মেলা।
হরির ঘরখানা বেশ ভাল। মস্ত পালঙ্ক আছে, বইয়ে ঠাসা গোটা দুই আলমারি, টেবিল-চেয়ার কিছুরই অভাব নেই। দেওয়ালে কয়েকটা অয়েল পেন্টিং আছে। একটা ছবি এক বুড়ো মানুষের। গোটাতিনেক ছবি বিদেশের নিসর্গ দৃশ্যের। লাগোয়া বাথরুমও আছে। জানলা খুললেই বাগান। এত সুন্দর পরিবেশে হরি কখনও থাকেনি।
দুখিরামবাবু এবাড়িতে কখনও থাকেননি। এসব আসবাবপত্র, ছবি, বই কিছুই তাঁর নয়। হারানো বাড়িতে বহুকাল ধরেই এগুলো ছিল, তিনি এসব সমেতই বাড়িখানা কিনেছেন।
মোতিগঞ্জে হরিবন্ধুকে পৌঁছে দিতে সঙ্গে এসেছিল বাড়ির পুরনো ভূত্য গোবিন্দ। সকালবেলায় স্টেশনে নেমে একখানা টাঙ্গা ধরে তারা যখন এসে বাড়ির ফটকে নামল, তখনই গোবিন্দ খুব ভাল করে চারদিকটা দেখে নিয়ে বলল, “এ বাপু আমার বিশেষ সুবিধের ঠেকছে না।”