হরির এবার ভয় করতে লাগল। এই অন্ধকার থেকে তাকে বেরোতেই হবে। যেমন করে হোক। সে হঠাৎ প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল।
আর বিপদটাও ঘটল সঙ্গে-সঙ্গে। দড়াম করে একটা হোঁচট খেয়ে ছিটকে পড়ল সে। তারপর ঢালু বেয়ে অনেকটা গড়িয়ে গিয়ে ফের ধাক্কা খেল একটা কাঠের তক্তায়। মাথায় চোট পেল। কনুই ছড়ে গেল, হাঁটুতেও বেশ লাগল তার। মাথাটা ঝিমঝিম করায় কিছুক্ষণ চোখ বুজে বসে রইল সে।
তারপর চোখ খুলল।
আশ্চর্য! সুড়ঙ্গের ভিতরে একটা নীলচে আলো না! হরি তাকিয়ে দেখল, তার পিছনেই একটা ছোট্ট চৌকো কপাট একটু ফাঁক হয়ে আছে। ভারী নরম নীল একটা আলো ঠিকরে আসছে ওপাশ থেকে।
হামাগুড়ি দিয়ে গর্তের মধ্যে সাবধানে মুখ বাড়াল সে। তারপর বিস্ময়ে ‘থ’ হয়ে গেল। যা দেখল তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
দেখল, ফোকরের নীচে চমৎকার একখানা ঘর। সাধারণ ঘর নয়। কুয়োর মতো গোল হয়ে নেমে গেছে। অনেক নীচে, প্রায় বিশ ফুট গভীরে ঘরখানা দেখা যাচ্ছে। নীল আলোয় ভরে আছে ঘরখানা। সেই ঘরে কিছুই প্রায় নেই। একধারে লম্বা একটা কাঠের বাক্স। অন্য ধারে একটা ডেকচেয়ার।
প্রথমটা ভাল দেখতে পাচ্ছে না হরি। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর তার মনে হল, ডেকচেয়ারের ওপর রোগা একজন মানুষ শুয়ে আছে। খুব রোগা, সাদা চুল, ধপধপে ফসা রং। পরনে নীল রঙের একটা ড্রেসিং গাউন।
লোকটা কে? ও ঘরটাই বা কোন বাড়ির? হরির মনে হল, এটা গ্রিন ভ্যালি বা কুসুমকুঞ্জ নয়। সুড়ঙ্গ ধরে সে ভুল পথে অন্য কোনও বাড়িতে চলে এসেছে।
সে যাই হোক, এখন তার সাহায্য দরকার। যেমন করেই হোক, এই অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে তাকে গ্রিন ভ্যালিতে ফিরতে হবে। ওই রোগা লোকটাকে তার শত্রুপক্ষের বলে মনে হচ্ছিল না। আর যদি হয়ও তো, কীই বা করার আছে!
সে দেখতে পেল, লোকটা ডেকচেয়ারে শুয়ে একটা বই পড়ছে যেন। হরি ডাকল, “শুনছেন! আমাকে একটু সাহায্য করবেন?”
ডাক শুনে লোকটা তার দিকে তাকাল।
এত দূর থেকেও হরির মনে হল, ঘরের নীল আলোটা যেন ওর দু’খানা উজ্জ্বল নীল চোখ থেকেই বেরিয়ে আসছে। এমন সুন্দর চোখ সে কখনও দ্যাখেনি।
লোকটা কুয়োর ভিতর থেকে গমগমে গলায় বলল, “কী চাও? এখন আমাকে বিরক্ত কোরো না। আমি বাইবেল পড়ছি।”
“আমি গ্রিন ভ্যালিতে যাব। ভুল পথে এসে পড়েছি এখানে। আমার খুব বিপদ।”
লোকটা রোগা হাতে নিজের সাদা চুল মুঠো করে চেপে ধরে বলল, “কেন যে বিরক্ত করো আমায়। যে পথে এসেছ সেইপথে ফিরে যাও। কুড়ি পা হাঁটবার পর ডান দিকে ঘুরে যেও। ঠিক কুড়ি পা, গুনতে যেন ভুল না হয়। দরজাটা টেনে দাও। বিরক্ত কোরো না।”
লোকটা একটু রাগী ঠিকই। কিন্তু খারাপ নয়। পটলদা নিশ্চয়ই চিনবে। পরে জেনে নিলেই হবে।
হরি দরজাটা টেনে দিয়ে সুড়ঙ্গের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঠিক কুড়ি পা হাঁটল, তারপর ডান দিকে ফিরল।
আশ্চর্যের বিষয়, ডান দিকে দশ পাও হাঁটতে হল না, সে পৌঁছে গেল সিঁড়ির গোড়ায়। চটপট সিঁড়ি বেয়ে উঠে সে এসে দাঁড়াল ছবির পিছনে। তারপর নিঃশব্দে ছবিটা সামান্য সরিয়ে নীচে তাকাতেই সে নিজের ঘরখানা দেখতে পেল।
ঘরে আলো জ্বালানোই ছিল। ছবির নীচে টেবিলের ওপর চেয়ার তেমনি দাঁড় করানো। আর টেবিলের সামনেই সেই দানবের মতো লোকটা দাঁড়িয়ে হাঁ করে তার দিকে চেয়ে আছে। চোখ দুটো বিস্ময়ে গোল।
হরি একটু সরে গেল ভিতর দিকে। অপেক্ষা করতে লাগল।
লোকটা কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সন্তর্পণে টেবিলের ওপর উঠল। তারপর চেয়ারের ওপরে। হাত বাড়িয়ে ছবিটাকে নাড়াবার চেষ্টা করল। বল বিয়ারিং-এর প্যানেলে ছবিটা নিঃশব্দে পাশের দিকে সরে যেতে লাগল।
হরি এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। হাতের টর্চটা বাগিয়ে ধরাই ছিল তার। হামাগুড়ি দিয়ে বসে টর্চটা দিয়ে সে প্রচণ্ড জোরে লোকটার মাথায় মারল।
লোকটা মাথাটা চেপে ধরল, কিন্তু একটা চাপা গর্জন ছাড়া তেমন কোনও শব্দ করল না।
আতঙ্কিত হরি টর্চটা আবার তুলল মারার জন্য। কিন্তু সেই সুযোগ হল।লোকটা বিদ্যুৎ-বেগে হাত বাড়িয়ে টর্চসুষ্ঠু তার হাতটা চেপে ধরল।
তারপরই হুড়মুড় করে টেবিল, চেয়ার, হরি এবং লোকটা ছয়ছত্রখান হয়ে পড়ে গেল মেঝের ওপর।
চোট যে খুব বেশি লাগল তা নয়। হরি পড়েছিল লোকটার ওপর। পড়েই সে লাফ দিয়ে উঠে লাঠিটা নেওয়ার জন্য যাচ্ছিল।
লোকটা বাহাদুর বটে, ওভাবে পড়ে গিয়েও দমেনি। শোওয়া অবস্থাতেই একটা ল্যাং মেরে ফেলে দিল হরিকে।
তারপর দুজনেই দুটো ক্রুদ্ধ বাঘের মতো লাফিয়ে পড়ল দু’জনের ওপর।
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই হরি বুঝল, এর সঙ্গে এঁটে ওঠা যাবে না। এর গায়ে হাতির মতো জোর।
“জগুরাম!” বলে একবার চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করল হরি। কিন্তু অস্ফুট চিৎকারটা গলা দিয়ে বেরোবার আগেই লোকটা তার মুখে একটা প্রচণ্ড ঘুসি মারল।
ঘুসিটা খেয়ে চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে মেঝের ওপর পড়ে গেল হরি। তারপর আর জ্ঞান রইল না।
৮. ওদিকে কুসুমকুঞ্জের একতলার
ওদিকে কুসুমকুঞ্জের একতলার বাইরের ঘরে পটল দাস ভয়ে আর শীতে গায়ের আলোয়ানটা ভাল করে জড়িয়ে থরথর করে কাঁপছিল। তাকে ঘিরে মোট ছ’জন লোক। আর-একটা লোক গেছে হরিকে ধরে আনতে। এই ছ’জনের মধ্যে তিনজনের অবস্থা বিশেষ সুবিধের নয়। একজনের বাঁ চোখ ফুলে ঢোল হয়ে আছে। একটা ভেজা রুমাল চোখে চাপা দিয়ে সে গোঙানির শব্দ করছে বসে বসে। আর একজন ডান হাতখানা ভেঙেছে। গদাধর তার হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধছে আর লোকটা যাচ্ছেতাই ভাষায় পটল দাসের উদ্দেশে গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে নাগাড়ে। তৃতীয় জনের কী হয়েছে বলা মুশকিল। তবে সে লম্বা হয়ে পড়ে আছে একধারে, চেতনা নেই বললেই হয়। পটল দাসের যতদূর মনে আছে, এই লোকটার মাথায় সে একটু তবলা বাজিয়ে দিয়েছিল। তবে পটল দাসের গাঁটওয়ালা বুড়ো আঙুলগুলোর বোল আলাদা, মাথার মধ্যে কত কী গণ্ডগোল পাকিয়ে উঠেছে কে জানে।