পটল দাস ভারী অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “কিছু হয়নি মানে? কে বলল কিছু হয়নি? ঘাড়টা টনটন করছে, মাজা ঝনঝন করছে, হাত কনকন করছে, চোখে সর্ষেফুল দেখছি! তবু বলছ কিছু হয়নি? আর আমি তো চোর নই যে, চোরের মার হজম করতে পারব।”
বেঁটে লোকটা ভোজালির বাঁটে হাত রেখে বলল, “আমরা যা জানতে চাই তা যদি সাফ-সাফ না বলো, তা হলে জানে খতম হয়ে যাবে, তা বুঝতে পারছ? তিনটে আনাড়িকে ঘায়েল করেছ বলে যে আমাদেরও জব্দ করবে সে আশা কোরো না। এবার আর রদ্দাফদ্দা নয়, স্রেফ গলা ফাঁক করে দেব।”
“অত ভয় দেখাতে হবে না। ভয় আমি পেয়েই আছি। কিন্তু জানলে তো বলব বাবারা! আমি তো সাতে-পাঁচে থাকি না। আমার ছেলে প্যালারাম রেলে চাকরি পেয়ে গেছে। সে টাকা পাঠাতে শুরু করলেই আমরা বুড়োবুড়ি কাশীবাসী হব। আর এ-তল্লাটে নয়। বুড়োবয়সে বড় হেনস্থা হতে হচ্ছে গো।”
“এঃ, একেবার ধর্মের ষাঁড়! কাশীবাসী হবেন। কাশী তোমাকে এখানেই বাস করাচ্ছি।”
এই বলে বেঁটে লোকটা পটলের ঘাড়টা ধরে টেনে দাঁড় করাল। তারপর পটাস করে গালে একটা চড় কষিয়ে বলল, “কাশীবাসী বুড়ো, তা তুমি যদি এতই ধাম্মিক তা হলে আমার দলের তিনটে ছেলেকে অমন গুণ্ডার মতো মারধর করলে কেন?”
চড় খেয়ে পটল দাস গালে হাত বোলাতে-বোলাতে অবাক গলায় বলল, “দুধের বাছাদের আমি আবার মারলুম কখন? আমবাগানের ভিতর দিয়ে পেটে খিদে নিয়ে যাচ্ছিলুম বাবারা, আমার দোষঘাট নিও না। পেটে তখন চোঁচা খিদে। ওদিকে বাড়িতে আজ ফুলকপি আর ভাজা-মুগের ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না হয়েছে। সেই অবস্থায় তোমরা সব এসে আমাকে ঘিরে ধরলে। তখন কি খিদের চোটে মাথার ঠিক ছিল বাপ! বুড়োমানুষ, খিদে আর ভয়ে বেমক্কা হাত-পা ছুঁড়েছি হয়তো, তাইতেই দুধের বাছাদের একটু লেগেছে। তবে ইচ্ছে করে কিছু করিনি বাবারা।”
বেঁটেটা দু’কোমরে দু’হাত রেখে বুক চিতিয়ে বলল, “তা আমরাও তোমার গায়ে ইচ্ছে করে হাত তুলছি না বুড়ো-ঘুঘু। আমাদের হাত আপনা থেকেই উঠে যাচ্ছে। এখন বলো তো বাছাধন, তোমাদের পাগলা-সাহেবের কবরটা কী করে খুঁজে পাব?”
পটল দাস কানে হাত চাপা দিয়ে সভয়ে বলল, “রাম রাম, রাম রাম। রাতবিরেতে ওসব নাম উচ্চারণ করতে নেই। উনি কুপিত হবেন।”
গদাধর গর্জন করে বলল, “ব্যাটা ইয়ার্কি করছে। একটু আগেই হরিবন্ধুকে বলছিল, আমি নিজের কানে শুনেছি।”
বেঁটেটা চতুর্থজনের দিকে ফিরে বলল, “তুই গিয়ে হরি ছোঁড়াটাকে ধরে নিয়ে আয় তো। দু’জনের মধ্যে যখন এত ভাব, তখন দু’জনের পেট
থেকেই কথা বার করা যাক।”
চতুর্থজন এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি। চারজনের মধ্যে সেই সবচেয়ে লম্বা আর চওড়া। একখানা দানব বললেই হয়। নিঃশব্দে ঘাড়টা একটু কাত করে চলে যাচ্ছিল। পিছন থেকে গদাধর বলল, “ওবাড়িতে একটা দরোয়ান আছে। বিশাল চেহারা। সে খুব ঘুমোয়। যদি হঠাৎ জেগে যায় তবে চপারটা চালিয়ে দিস।”
লোকটা চলে গেল।
ভয়ে হরির হাত-পা হিম হয়ে এল। সে যতদূর জানে, জগুরাম এ-সময়টায় তুলসীদাসের দোহা পড়ে। একটু রাতে ঘুমোতে যায়। হয়তো এখনও ঘুমোয়নি। কী হবে তা হলে?
হঠাৎ সে তাকিয়ে দেখল পটল দাস কেমন অদ্ভুত চোখে তার দিকেই চেয়ে আছে। না, পটলদা নিশ্চয়ই তাকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু কিছু একটা আন্দাজ করেছে। ছবিটা যে একটু সরানো, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে। বোধহয় অনুমান করছে যে, ছবির আড়াল থেকে কেউ দেখছে তাদের।
পটল হঠাৎ ভেউ-ভেউ করে কেঁদে উঠে বলল, “কপালে এত দুঃখুও ছিল রে প্যালারাম! কোথায় রে প্যালা, কোথায় পালিয়ে রইলি বাপ! প্যালা! প্যালা! প্যালা রে!”
“চোপ!” বেঁটেটা গর্জন করে উঠল। কিন্তু হরির আজকাল বুদ্ধি খুলেছে। হয়তো বিপদে পড়লেই মানুষের বুদ্ধি খোলে। পটলদা যে কৌশলে তাকে পালিয়ে যেতে বলছে, এটা বুঝতে তার একটুও দেরি হল না। একমাত্র পটলই বোধহয় বুঝতে পেরেছে, ছবির পিছনে কে।
হরি দ্রুতপায়ে যে পথ ধরে এসেছিল সেই পথে ফিরে চলল। কিন্তু মুশকিল হল টর্চটা জ্বলছে না। ব্যাটারি কমজোরি হয়ে পড়েছিল। এখন একেবারেই গেছে। সামনে ঘুটঘুটি অন্ধকার। হরি তবু সিঁড়ি ভেঙে নেমে গলিটা পেয়ে হাঁটতে লাগল, অন্ধকারে যতদূর সম্ভব দ্রুতবেগে।
কিন্তু হঠাৎ তার মনে হতে লাগল, সে ভুল পথে যাচ্ছে।
আসার সময় সে অবশ্য একটা গলি ধরেই এসেছিল। অন্য কোনও সুড়ঙ্গ তার নজরে পড়েনি। কিন্তু নিবুনিবু টর্চের আলোয় গভীর অন্ধকার সুড়ঙ্গে সে আর কতটুকুই বা দেখেছে! আন্দাজে সে বুঝল, এতক্ষণে তার গলির মুখে পৌঁছে যাওয়া উচিত। কিন্তু পৌঁছয়নি। ওদিকে গুণ্ডাটা গেছে তাকে ধরে আনতে। জগুরাম বাধা দিলে খুন হয়ে যাবে। তারপর গুণ্ডাটা তার ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর চেয়ার দাঁড় করানো দেখে সন্দেহ করবে। সুড়ঙ্গের পথ খুঁজে বের করতে তার মোটেই দেরি হবে না। হরি যদি তাড়াতাড়ি ঘরে পৌঁছতে পারে এবং লাঠিটা বাগিয়ে ধরতে পারে তা হলে হয়তো শেষরক্ষা হয়।
কিন্তু অন্ধকারে আরও মিনিট-দুই জোর কদমে হেঁটেও কোথাও গলির মুখ পেল না হরি। পথটা যেন বড্ড গড়িয়ে নামছে এবার। মাটির সোঁদা গন্ধ আসছে নাকে।
হরি একটু দাঁড়াল। মাটির তলাটা ভীষণ নিস্তব্ধ। কবরের মতো নিথর। অন্ধকার এত জমাট যে, মনে হয় অন্ধ হয়ে গেছি।