ফিরে আসবে বলে হরি যখন ওপর দিকে উঠছে তখন মাঝপথে সে বাঁদিকে আরও একটা ফোকর আবিষ্কার করল। দেওয়ালের খাঁজে খুবই সঙ্কীর্ণ একটা ফাটলের মতো, নামবার সময় চোখে পড়েনি।
হরি তাতে মুখ বাড়িয়ে দেখল, ভিতরে খুব সরু একটা গলিপথ। এ-পথও পটল দাসের চোখ এড়ায়নি নিশ্চয়ই। সে সন্তর্পণে ভিতরে পা দিল।
এ-পথটাও নীচে নেমেছে। হরি হাঁটতে লাগল।
বেশ খানিকটা হাঁটার পর পথ আবার ওপরে উঠতে লাগল। অবশেষে খানিকটা সিঁড়ি বেয়ে হরি যেখানে এসে দাঁড়াল, সেটা একটা বন্ধ দরজা। ঠেলল। দরজাটা খুলল না।
একটু ভাবল হরি। দরজা? নাকি তার ঘরের মতোই এখানেও ছবি?
সন্তর্পণে দরজাটাকে পাশের দিকে ঠেলল হরি। নিঃশব্দে দরজা সরে গেল। সামনেই একটা ঘর। তবে প্রায় দশ ফুট নীচে তার মেঝে। হরি ঠিক তার ঘরের ছবির পিছনকার মতোই একটা গর্তের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তবে নীচের ঘরটা তার নয়। অন্ধকার হলেও বুঝতে পারছিল হরি। তার মনে হল, এটা দুখিরামবাবুর গ্রিন ভ্যালির কোনও ঘরও নয়।
তবে কি কুসুমকুঞ্জ? গায়ে একটু কাঁটা দিল হরির।
দম চেপে কিছুক্ষণ নীচের অন্ধকার ঘরটার দিকে চেয়ে রইল সে। টর্চটা জ্বেলে দেখতে তার কেমন যেন সাহস হল না। তার মনে হচ্ছিল, ঘরটা জনশূন্য না-ও হতে পারে। কেউ যদি ঘাপটি মেরে থেকে থাকে তবে মুশকিল হবে।
অন্ধকার হলেও আবছাভাবে হরি দেখতে পাচ্ছিল, ঘরে কিছু আসবাবপত্র রয়েছে। উলটো দিকে একটা জানালা দিয়ে বাইরের খুব মৃদু আলোর আভাস আসছে। তাই দিয়ে যতটা দেখা যায় তাতে হরির মনে হল, ঘরটা ফাঁকাই।
সাহস করে এবার টর্চটা জ্বালল সে।
সাধারণত বড়মানুষদের বসবার ঘর যেমন হয় তেমনি সাজানো। সোফাসেট, একটা ডিভান, টেবিল। তবে আসবাবগুলো বড্ড পুরনো আর ভাঙাচোরা। দেওয়ালে নোনা লেগেছে, ঘরের কোণে-কোণে ঝুল জমেছে মেলা। তবে মেঝেয় তেমন ধুলোর আস্তরণ দেখতে পেল না সে।
তবে কি এখানে লোকজনের আনাগোনা আছে? হঠাৎ বাইরে থেকে একটা শব্দ এল। মনে হল জানালার ওপাশে কে যেন মাটিতে আছাড় খেল ধপাস করে। তারপর একটা চেনা গলার আর্তনাদ, “ওরে বাবা রে!”
টপ করে টর্চটা নিবিয়ে দিল হরি। বাইরে কিছু-একটা হচ্ছে। কে যেন চাপা গলায় বলল, “চল ব্যাটা, সত্যি কথা না বললে আজ তোকেই কবর দেব।”
“আমি কিছু জানি না।”
“জানিস কি না জানিস সেটা বোঝা যাবে ওষুধ পড়লে।”
“উঃ, ঘাড় ভেঙে যাবে যে…”
“ভাঙবার জন্যই তো রদ্দা দেওয়া হচ্ছে।”
“ছেড়ে দাও বাবারা, আমি বুড়ো মানুষ।
“বুড়ো! বর্টে! কিন্তু তোমার বুড়ো হাড়ে যে ভেলকি খেলছিল বাবা একটু আগে! আমাদের তিন-তিনটে মরদকে যে তুমি ঘায়েল করেছ বুড়ো শয়তান! এখন আবার ন্যাকার মতো বুড়ো সাজা হচ্ছে?”
“আ হা হা, হাতটা যে গেল! অত জোরে মোচড়ায় নাকি রে! এ কি বাপু ইস্টিলের জিনিস?”
পটাং করে একটা শব্দ হল। কিছুক্ষণ সব চুপচাপ।
তারপর একটা ভারী জিনিসকে হেঁচড়ে আনার শব্দ হল। কে যেন চাবি বের করে তালা খুলছে ঘরের।
হরি ছবিটা খুব সন্তর্পণে টেনে গর্তটা ঢেকে দিল। শুধু চুলের মতো একটু ফাঁক রাখল।
বাঁ ধারে একটা দরজা কাঁচকোঁচ করে খুলে গেল। চারজন লোক পঞ্চম আর-একটা লোককে হেঁচড়ে টেনে এনে ঘরের মেঝের ওপর ফেলে দিল।
মেঝেয় পড়ে থাকা লোকটা যে পটল দাস তাতে সন্দেহ নেই হরির। কিন্তু পটল তো খিচুড়ি খেতে বাড়ি গেল। তাকে এরা পেল কোথায়?
আর লোক গুলোই বা কারা?
লোকগুলো একটা মোমবাতি ধরিয়ে টেবিলের ওপর রাখল। সেই আলোয় হরি দেখতে পেল, চারজনের একজন গদাধর। আর তিনজনই অচেনা। তবে তাদের চেহারা এবং চোখমুখ দেখলে সহজেই বোঝা যায় যে, এরা ভাল লোক নয়।
পটল দাস মেঝের ওপর পড়ে গোঙাচ্ছিল।
কোমরে ভোজালিওলা বেঁটে এবং ভারী জোয়ান একটা লোক বলল, “এ, এই উটকো বুড়োটার জন্য বহুত পরেসানি গেছে। কে জানত যে ব্যাটা কুংফু-কারাটে জানে।”
হাতে একটা ছোট লাঠিওলা কালো ডাকু চেহারার লোক বলল, “আমি তো ভাবলুম এটা মানুষই নয়। ভূতফুত হবে। নইলে রাজু, দিপু আর অনিলকে ওভাবে শুইয়ে দেওয়া কি যার-তার কাজ!”
বেঁটেটা বলল “ওদের কী হল? কে দেখছে ওদের?”
“চালু আছে। চোট তেমন সাঙ্ঘাতিক নয়। শক্ত ছেলে। উঠে পড়বে।”
বেঁটেটা কিছুক্ষণ পটল দাসের দিকে চেয়ে থেকে গদাধরের দিকে চোখ তুলে বলল, “গদাই, তা হলে এই লোকটাই?”
“হ্যাঁ, হরিবন্ধুর ঘরে একেই দেখেছি। এর নাম পটল দাস। একসময়ে নাম-করা চোর ছিল।”
“চোর! ভেরি গুড। চোরেরাই সব অন্ধিসন্ধির খবর রাখে।”
গদাধব ওরফে গদাই বলল, “পটল দাস হরিবন্ধুকে বলছিল, পাগলা-সাহেবের কবর খুঁজে বার করার সঙ্কেত ও জানে।”
বেঁটেটা ডাকু লোকটাকে বলল, “বাইরে বাগানের কল থেকে একটু জল এনে চোরটার মুখে-চোখে ঝাঁপটা দে। পেট থেকে কথা বের করতে হবে।”
জলের ঝাঁপটা দেওয়ার কথাতেই কি না কে জানে, পটল দাস একটু ককিয়ে উঠে বলল, “পেটে কি আর কথা আছে বাপু? এখন যে নিজের বাবার নামটাও ভুলে বসে আছি। না বাপু, মাথায় গাঁট্টা মারাটা তোমাদের উচিত হয়নি।”
একথায় চারজনই পরম্পর একটু মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।
বেঁটেটা দাঁত কড়মড় করে বলল, “ওরকম চোরের মার খেয়েও তোমার কিছু হয়নি দেখছি। বেশ শক্ত ধাতের লোক তো তুমি। কিন্তু তার চেয়েও শক্ত ওষুধ আমাদের কাছে আছে তা জানো?”