“তা থাক না। ভূত কি ভাল?”
পটল দাস মাথা নেড়ে বলল, “ভূত হোক যা-ই হোক, মোতিগঞ্জের লোক পাগলা-সাহেবকে বড় ভালবাসে। আমরা মোতিগঞ্জের লোকেরা তার কবরটা খুঁজছি কেন জানো? যাতে আমাদের আগে অন্য কোনও বদমাস তা খুঁজে না পায়। আমরা খুঁজে পেলে সেই কবরের চারধারে শক্ত পাহারা বসাব।”
“কী করে খুঁজে পাবে? কোনও চিহ্ন আছে?”
“আছে। তবে সে-সব আর জানতে চেও না। বিপদে পড়বে।”
এ-সব কথা বিশ্বাস করবে কি না, তা নিয়ে একটু দ্বিধায় পড়ল হরি। সে কী একটা বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ পটল দাস ক্রুদ্ধ একটা চাপা গর্জন করে জানালার দিক ছুটে গেল!
চমকে উঠে হরি বলল, “কী হল পটলদা?”
পটল জানালার ওপর ঝুঁকে বাইরে কী দেখতে লাগল। জবাব দিল। তারপর মুখটা ফিরিয়ে চাপা গলায় বলল, “তুমি একটি নষ্টচন্দ্র।”
“তার মানে?”
“তখন থেকে নানা কথায় ভুলিয়ে আমার পেট থেকে কথা বের করছ। আর আমারও বুড়ো বয়সে এখন বকবকানিতে পেয়েছে। হুট বলতে যার-তার সঙ্গে বকবক করতে লাগি।”
“তাতে কী হয়েছে?”
“হবে আবার কী? কোন নচ্ছার যেন জানালায় দাঁড়িয়ে আড়ি পেতে আমাদের কথা শুনছিল।”
হরি একটু সিটিয়ে গেল।
পটল দাস মাথা নেড়ে বলল, “গতিক খুব সুবিধের নয় রে বাপু। গোপালটাকে মারল, তোমাদের ওপর হামলা হল, গতিক আমার ভাল ঠেকছে না।”
হরি এবার একটু রাগ করে বলল, “তোমাদের পাগলা-সাহেব তো খুব বীর। কাল রাতে যখন গোপালকে ওরা মারল, তখন তাকে বাঁচাতে আসেনি কেন?”
পটল দাস হরির দিকে কুতকুত করে চেয়ে থেকে বলল, “না বাঁচালে গোপাল বেঁচে আছে কী করে? যারা ইট মেরেছিল, তারা কি সোজা লোক? অল্পে ছেড়ে দিত নাকি ভেবেছ? গোপালের মতো ডাকাবুকো ছেলেকে নাগালে পেলে খুন করে ফেললেই তাদের সুবিধে। করতে যে পারেনি, সে ওই পাগলা-সাহেবের জন্যই।”
“কিন্তু ইটের ঘা-ই বা খেল কেন?”
“অত আমি জানি না। তবে যিশুবাবার যেমন অনেক ক্ষমতা, তেমনি শয়তানেরও অনেক ক্ষমতা। এই ধরো না মোতিগঞ্জের দারোগাসাহেবের ক্ষমতা তো কিছু কম নয়। কিন্তু তবু এই পটল দাসের মতো লোকও তো এখানে বেঁচে-বর্তে করে-কম্মে খাচ্ছে। ক্ষমতা পটল দাসেরও তো কিছু আছে।”
“তা বটে।”
“এও তাই। মোতিগঞ্জের লোকেদেরও ঘরে চুরি হয়, তারা হোঁচট খায়, অপঘাত হয়, মারদাঙ্গা গুণ্ডামি-ষণ্ডামিও মেলা আছে। পাগলা-সাহেব কি সব কিছুতে গিয়ে জোটে? তবে মাঝে-মাঝে দেখা দেয় বটে। সে তার ইচ্ছেমতো। কখন কবর থেকে বেরিয়ে আসবে, তার কিছু ঠিক নেই। লোকটা পাগলা ছিল তো। কিন্তু মেলা কথা হয়ে গেছে। আর নয়। ঝুমরি তোমার ভাত নিয়ে এল বলে। রাতও হয়েছে।”
“কিন্তু গল্পটা যে আমার আরও শুনতে ইচ্ছে করছে!”
“ওরে বাবা! এ গল্প শুনতে বসলে রাতের পর রাত কাবার হয়ে যাবে, তবু শেষ হবে না। আমার খিদেও পেয়ে গেছে খুব। প্যালারামের মা আজ ফুলকপি দিয়ে জব্বর খিচুড়ি রাঁধছে দেখে এসেছি। জুড়িয়ে গেলে খিচুড়িতে আর গোবরে তফাত নেই।”
এই বলে পটল দাস দরজা খুলে সাঁত করে বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
আর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঝুমরি তার খাবার নিয়ে ঢুকল ঘরে।
৭. খেয়েদেয়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ
খেয়েদেয়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে এইসব ঘটনা ভাবতে লাগল হরি। ভেবে কোনও কূল-কিনারা পেল না। মাথা গরম হয়ে গেল।
হঠাৎ তার নজর গেল দেওয়ালের ছবিটার দিকে। ওর পিছনে একটা গুপ্ত দরজা আছে। হরি আর দেরি করল না। জানালার পাল্লা ভাল করে এটে পদা টেনে দিল, যাতে বাইরে থেকে কেউ দেখতে না পায়। তারপর টেবিলটা দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করিয়ে তার ওপর চেয়ার তুলল। চেয়ারের ওপর দাঁড়াতেই ছবি তার নাগালে এসে গেল।
ছবিটা একটু ঠেলতেই সরে গেল। পিছনে ফোকর। টর্চ পকেটে নিয়ে বুক ঘষটে, হাতে ভর দিয়ে সে উঠে পড়ল সুড়ঙ্গের মুখে। তারপর ছবিটা টেনে গর্তটা ঢেকে দিল।
টর্চ জ্বেলে চারধারটা দেখল সে। খুবই সঙ্কীর্ণ একটা গলির মতো জায়গা। মাথা নিচু না করলে ছাদে মাথা ঠেকে যায়। টর্চ ফেলে কয়েক পা এগোল হরি। গলিটা তার ঘরের সমান্তরাল খানিকদূর গিয়েই একটা সিঁড়ির মুখে শেষ হয়েছে। খাড়া সিঁড়ি। ধাপগুলো বেশ উঁচু-উঁচু।
পটল দাস এই পথে আনাগোনা করে, সুতরাং ভয় পাচ্ছিল না হরি। সে সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগল। নামতে নামতে মনে হল সে পাতালের দিকে নেমে যাচ্ছে। তার ঘরের মেঝের অনেক নীচে।
সিঁড়ি যেখানে শেষ হল সেটা একটা অপরিসর ঘর। ঘরে কিছুই নেই। শুধু একধারে একটা মাদুর পড়ে আছে। মাদুরের ওপর একটা দেশলাই আর কয়েকটা বিড়ি। হরি বুঝল, পটল দাস মাঝে-মাঝে এখানে বিশ্রাম করতে আসে।
সিঁড়ির উলটো দিকের দেওয়ালে আর-একটা দরজা দেখা গেল। লোহার দরজা, বেশ মজবুত। তবে হুড়কো বা ছিটকিনি নেই। হরি দরজাটা খুলে আর-একটা গলি দেখতে পেল।
গলি ধরে বেশ অনেকটা সমতলে হাঁটল হরি। তারপর আচমকাই টের পেল, গলি ঢালু হয়ে নেমে যাচ্ছে।
নামতে নামতে ফের আরও দু-তিনতলা নেমে এল হরি। গলিটা শেষ হল একটা গোল ঘরের মধ্যে। কোনও দরজা, জানালা, ফোকর কিচ্ছু নেই। চারদিকে নিরেট দেওয়াল আর ছাদ। আগে হয়তো টাকাকড়ি সোনাদানা লুকিয়ে রাখা হত এখানে।
হরি টর্চ জ্বেলে খুব ভাল করে চারদিকটা দেখল। বিড়ির টুকরো দেখে বুঝল, পটল দাস এখানেও আসে। সুতরাং এখানে নতুন কিছু আবিষ্কার করার আশা বৃথা।