“আঁক? সে আবার কী?”
“আঁক বোঝো না? আঁক মানে অঙ্ক আর কি। আঁক যেমন শক্ত, এখানে প্রতিটি ব্যাপারই তেমনি শক্ত। চট করে সব বোঝা যায় না। কেন যে কী হয়, তা খুব ভেবেচিন্তে বার করতে হবে। তোমার ব্যাপারটা নিয়েও ভেবে-ভেবে একটা কিছু বের করে ফেলব’খন। তবে দুখিরামবাবু এবাড়িটা কিনে ভাল কাজ করেননি।”
“কেন। এ বাড়ি কিনে খারাপ কী হয়েছে?”
“বললুম না এবাড়িটার ওপর অনেকের নজর আছে।”
“দুখিরামবাবু বাড়িটা কেনার আগে তো বাড়িটা এমনিই পড়ে ছিল। তখন নজর ছিল না?”
পটল দাস মাথা চুলকে বলল, “না, তখন ছিল না। এই হালে নজরটা খুব পড়েছে। আর তারা তোক সুবিধের বলেও মনে হচ্ছে না।”
“তুমি আমাকে ভয় দেখাতে চাইছ না তো পটলদা?”
পটল মাথা নেড়ে বলল, “না রে বাপু, তোমাকে ভয় দেখানো ছাড়া কি আমার কাজ নেই। লোকগুলো মোতিগঞ্জের নয়। বাইরের লোক। তারা এখানে ইতিউতি কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওই ‘কুসুমকুঞ্জ’ আর এই ‘গ্রিন ভ্যালি’–এই দু’খানা বাড়ির ওপরেই নজর।”
“তারা কী খুঁজছে পটলদা? পাগলা-সাহেবের কবর নয় তো!”
“রাম রাম, কী যে সব বলো না! ও সব মুখে উচ্চারণও করতে নেই।”
“আমি জানি পটলদা। পাগলা-সাহেবের গলায় একটা দামি ক্রস আছে। আর পাগলা-সাহেবকে কবর থেকে তুলতে পারলেই তাকে আর মোতিগঞ্জে দেখা যাবে না।”
পটল দাস জুলজুল করে কিছুক্ষণ হরির মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, “টুবলু ছোঁড়াটা মহা পাজি। তুমি বাইরের লোক, খামোখা তোমাকে অত কথা বলে দিয়ে বিপদে ফেলা হল। না জেনেই ভাল ছিল।”
হরি কাকুতি-মিনতি করতে লাগল, “খানিকটা যখন জেনেই ফেলেছি পটলদা, তখন পুরোটাই আমাকে জানিয়ে দাও। পাগলা-সাহেবের কবর কোথায়, তা কি তুমি জানো?”
পটল দাস একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়ল, “না রে ভাই, কেউই জানে না। ‘মেঠো ইঁদুর’ বলে সবাই আমাকে ডাকে, তবু আমিও আজ অবধি হদিস করতে পারিনি। অনেক খুঁজেছি।”
“তুমি পাগলা-সাহেবকে দেখেছ কখনও? জ্যান্ত অবস্থায়?”
“জ্যান্ত দেখিনি। পাগলা-সাহেব মরেছে বোধহয় সত্তর-আশি বছর আগে। কোন বাড়িতে যে সে থাকত তাও কেউ নিশ্চয় করে বলতে পারে না। সে মারা যাওয়ার পর তার বিশ্বাসী কয়েকজন চাকর তাকে গোপনে কোথাও কবর দিয়ে দেয়। সে কবরেরও হদিস নেই। তবে ইদানীং পাগলা-সাহেব সম্পর্কে কোন খবরের কাগজে নাকি কী একটা গপ্পো বেরিয়েছে। তারপর থেকে নানারকম খোঁজখবর হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, কুসুমকুঞ্জ আর গ্রিন ভ্যালি, এই দুটো বাড়ি নিয়েই নাকি পাগলা-সাহেব থাকত। গ্রিন ভ্যালিতে থাকত তার চাকরবাকর, খানসামা, বাবুর্চিরা; আর সে নিজে থাকত কুসুমকুঞ্জে। সত্যি-মিথ্যে জানি না। সেই গল্পে আরও লিখেছ যে, পাগলা-সাহেবের গলায় যিশুবাবার যে মাদুলি আছে, তার নাকি লাখ-লাখ টাকা দাম।”
“তুমি কি সেই গল্প শুনেই কবরটা খুঁজতে লেগেছ?”
তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে পটল বলল, “না রে বাবা, না; এ-গল্প আমরা ছেলেবলা থেকেই শুনে আসছি। মোতিগঞ্জের লোকেরা আর যা-ই করুক, পাগলা-সাহেবের কবরে হাত দেবে না। বারণ আছে। সাহেব মোতিগঞ্জের লোকদের জন্য করেছেও অনেক। গরিব-গুবোদের খুব দেখত, চোর গুণ্ডা বদমাসদের ঢিট রাখত, তার ভয়ে গোটা মোতিগঞ্জে কোনও অশান্তি ছিল না। নিজে ছিল সাধু প্রকৃতির। দুটো কয়লাখনি আর একটা মস্ত কাঠের কারবার ছিল তার। দেদার টাকা রোজগার করত, আর দু’হাতে বিলিয়ে দিত। মরলও মানুষের ভাল করতে গিয়ে। একদিন একটা উটকো লোক এসে সাহেবের পায়ের ওপর পড়ে বলল, “হুঁজুর, গাঁয়ের লোকেরা আমার ঘরদোর জ্বালিয়ে দিয়েছে, বউবাচ্চা সব মেরে ফেলেছে, আপনি বিহিত করুন। আমি ছোট জাত, চাষবাস করে গতরে খেটে অবস্থা একটু ফিরিয়েছি দেখে গাঁয়ের লোকের চোখ টাটাচ্ছে।’ সাহেব দুর্বলের ওপর অত্যাচার সইতে পারত না। শুনেই ঘোড়ায় চেপে রওনা হয়ে গেল একা। তা বেশিদূর যেতে হয়নি। শহরের পুব দিকে মস্ত জংলা জমিটায় পড়তেই প্রায় বিশজন লোক সাহেবকে সড়কি বল্লম আর তীর মেরে ঝাঁঝরা করে দিল। চাকরেরা একটু দেরিতে খবর পেয়ে যখন দৌড়ে গেল, তখনও ডাকাতেরা সাহেবের গলা থেকে যিশুবাবার মাদুলিটা খুলে নিতে পারেনি। তাড়া খেয়ে তারা পালিয়ে যায়। চাকরেরা সাহেবকে নিয়ে এসে গোপনে কবর দিয়ে দেয়।”
“গোপনে কেন?”
“কে জানে কেন। তবে সাহেব নাকি তার চাকরদের বলেই রেখেছিল, হঠাৎ তার মরণ হলে এমন জায়গায় যেন কবর দেওয়া হয়, যা কেউ খুঁজে পাবে না।”
“সেই চাকরেরা কোথায় গেল?”
“তা-ও কেউ জানে না। সাহেব মারা যাওয়ার পরদিন থেকেই সব ভোঁভাঁ। পুরনো লোকরা বলে, সাহেব নাকি তাদের বলে রেখেছিল, তিনি মারা যাওয়ার পরেই যেন সকলে গায়েব হয়ে যায়। তা লোকগুলো সাহেবকে একেবারে দেবতুল্য ভক্তি করত। তার কথায় উঠত বসত। সাহেবের আদেশও তারা অক্ষরে-অক্ষরে পালন করে গেছে।”
“কিন্তু একটা কথা পটলদা। সাহেব তো শুনি এখনও যখন-তখন দেখা দেয় আর লোককে বিপদ থেকে বাঁচায়। আজ আমাকেও বাঁচিয়েছে। তা নিজের কবরটা কি সাহেব আর বাঁচাতে পারে না? দুশমনদের তো সাহেব নিজেই তাড়িয়ে দিতে পারে।”
“সেও আর-এক গল্প। মাঘ মাসের শেষ দিকটায় যে-দিনে সাহেব খুন হয়, সেই দিনটায় সাহেব নাকি কবর থেকে বেরোয় না। শুয়ে-শুয়ে মানুষের অকৃতজ্ঞতার কথা ভেবে কাঁদে। সেই দিনটায় যদি কেউ কবর খুঁড়ে তাকে বের করতে পারে তো সাহবকে আর কখনও দুনিয়ায় দেখা যাবে না। সাহেব বলেই গেছে, অচেনা লোক তার কবর ছুঁলে তার আত্মা বহুদূর চলে যাবে, সেই দিনটা পড়বে সামনের অমাবস্যায়। আর সাতদিন বাকি।”