পড়তে বসেও সে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। কানে বাজছিল ঘোড়ার পায়ের সেই টগবগ শব্দ। কে পাগলা-সাহেব? কোথা থেকে উঠে আসে? কোথায় চলে যায়?
হঠাৎ খুব কাছ থেকে কে যেন বলে উঠল, “খুব ঠ্যাঙানি খেলে আজ যা হোক! ওঃ, তবু অল্পের ওপর দিয়ে গেছে!”
হরি একটু চমকে উঠে চারদিকে তাকাল। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল। জানালা ফাঁকা, আশেপাশে জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই। অথচ পটল দাস। যে ভূত নয় তা সে জানে। অথচ গলাটা পটল দাসেরই।
“পটলদা? তুমি কোথায়? অদৃশ্য-ফদৃশ্য হয়ে যাওনি তো?”
“চারদিকে চোখ রাখতে হয় রে ভাই, চারদিকে চোখ রাখতে হয়।”
হরির এবার আর ভুল হল না। পটলের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে ঘরের ভিতরেই, তবে ছাদের কাছ থেকে। দেওয়ালে যে বিশাল অয়েলপেন্টিংটা ছিল সেটা আধখানা সরানো। তার পিছনে একটা চৌকো ফোকর। পটল দাস সেই ফোকর দিয়ে মুখ বের করে খুব হাসছে।
ছবির পিছনে যে একটা ফোকর থাকতে পারে, সে-ধারণাও হরির ছিল। সে ডিটেকটিভ বইটইও বিশেষ পড়েনি যে, এসব কল্পনা করবে। তাই সে খুবই অবাক হয়ে গেল। বলল, “তুমি ওখানে উঠলে কী করে?”
পটল দাস বুড়ো মানুষ। কিন্তু ওই উপর থেকে অনায়াসে বেড়ালের মতো একটা লাফ মেরে মেঝেয় নেমে এল। আশ্চর্যের বিষয়, কোনও শব্দও হল না। নেমে ঘরের কোণ থেকে একটা ঝুলঝাড়ুনি নিয়ে ছবিটা আবার যথাস্থানে ঠেলে ফোকরটা ঢেকে দিল।
তারপর হরির দিকে চেয়ে বলল, “এসব পুরনো আমলের বাড়িতে কত সুড়ঙ্গ, পাতালঘর আর গুপ্ত কুঠুরি যে আছে, তার হিসেব নেই। তা আমিও পটল দাস। লোকে যে আমাকে আদর করে ইঁদুর বলে ডাকত, সেটা তো আর এমনি নয়। সব গর্ত, সব ফোকরের খবর রাখি। ওই ফোকর দিয়ে কতবার এবাড়িতে ঢুকেছি।”
“টুকে কী করো?”
পটল দাস একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নেড়ে বলল, “কিছু না রে ভাই, চুরিটুরি আমি ছেড়ে দিয়েছি। শুধু অভ্যাসটা বজায় রাখা। একটু ব্যায়ামও হয়।”
“ওই অত ওপর থেকে লাফ দিয়ে নামলে, তোমার ব্যথা লাগল না?”
“পাগল নাকি। বায়ুবন্ধন করে নিয়েছিলুম না! একবার কুঞ্জবাবু রাগ করে তিনতলার ছাদ থেকে পাঁজাকোলে তুলে ফেলে দিয়েছিল আমাকে। বুঝলে? তা গায়ে আঁচড়টিও লাগেনি। পড়েই ফের ছাদে গিয়ে কুঞ্জবাবুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললুম, ‘কাজটা মোটেই ঠিক করেননি মশাই, ওরকমভাবে ফেলে দিলে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। কিন্তু কুঞ্জবাবু ভাবলে, আমি ভূত, তিনতলা থেকে পড়ে অক্কা পেয়ে ভূত হয়ে শোধ নিতে এসেছি। তাই আমাকে দেখে গোঁগোঁ করে সেই যে অজ্ঞান হলেন, জ্ঞান ফিরল সাতদিন পরে।”
“আমাকে যখন আজ ছেলেগুলো মারছিল তখন তুমি কোথায় ছিলে?”
পটল দাস একটু হেসে বলল, “কাছেপিঠেই ছিলুম। আজকাল সব পুরনো দিনের কথা খুব মনে পড়ে কিনা। ওই যে কুঞ্জবাবুর কথা বললুম, আজ সেই তেনাদেরই তিনতলার ছাদে বসেবসে পুরনো কথা ভাবছিলুম। কুঞ্জবাবু কবে মরে গেছেন, বাড়িটা চামচিকে আর বাদুড়ের বাসা। ছাদে ঘুরে-ঘুরে পুরনো কথা ভেবে মনটা খারাপ লাগছিল।”
“তা হলে সবই দেখেছ?”
“দেখলুম। তবে অল্পের ওপর দিয়ে গেছে।”
হরি এবার নড়েচড়ে বসে বলল, “অল্পের ওপর দিয়ে গেল কেন বলল তো? ছেলেগুলো আমাকে আর টুবলুকে ছেড়ে হঠাৎ পালিয়ে গেল কেন? ঘোড়ায় চড়ে কে এসেছিল তখন?”
পটল দাসের মুখোনা কেমন যেন তোম্বা হয়ে গেল। মাথা নেড়ে বলল, “ঘোড়া! না তো, সেরকম কিছু দেখিনি।”
“চেপে যাচ্ছ পটলদা? তুমি সব জানো।”
“কী দেখব? বলেছি না, চোখে ছানি। প্যালারাম কাটিয়ে দেবে বলেছে। তারপর নাকি আবার সব দেখতে পাব আগের মতো।”
“তা হলে আমার মার খাওয়াটা দেখলে কী করে?”
পটল দাস বিরক্ত হয়ে বলল, “তোমার সঙ্গে কথা বলাটাই বাপু, বড় ভজকট ব্যাপার। ডাক্তারের ছেলে হয়ে যে কেন উকিলের ছেলের মতো জেরা করো।”
হরি হেসে ফেলল। বলল, “পাগলা-সাহেবের কথাটা তা হলে স্বীকার করবে না?”
পটল দাস তাড়াতাড়ি ডান কানে একটা আঙুল ভরে নাড়া দিতে দিতে বলল, “ওই দ্যাখো, সেই শ্যামাপোকাটা ফের কুটকুট করে কামড়াতে লেগেছে। তা ওরা তোমাকে ধরেছিল কেন বলো তো! কী চায় ওরা?”
“সেইটেই তো বুঝতে পারছি না। দু’দিনই ওরা আমাকে ধরল গোপালের খবর জানবার জন্য। গোপাল আমাকে কী বলেছে না বলেছে এইসব। কিন্তু আমাকে কেন ধরে বলো তো! গোপালের খবর তো গোপালের কাছ থেকেই নিতে পারে। আমি গোপালের কী জানি।”
পটল দাস বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল, “সেইটেই তো কথা। তবে কিনা তোমার কপালে আরও কষ্ট আছে।”
হরি চোখ বড় বড় করে বলল, “কেন পটলদা, আমি কী করেছি?”
“তেমন কিছু করোনি বটে, কিন্তু এই বাড়িতে যে এসে জুটেছ, এইটেই অনেকে ভাল চোখে দেখছে না। এই বাড়ির ওপর অনেকের নজর আছে। তার ওপর গোপাল হঠাৎ আলটপকা তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলল কেন, সেটাও ভাববার কথা।”
হরি অবাক গলায় বলল, “এবাড়িতে আছি বলেই বা কী দোষ হয়েছে, আর গোপাল আমার বন্ধু বলেই বা কী অন্যায়টা হল, আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।”
পটল দাস খুব বিজ্ঞের মতো হেসে বলল, “এই মোতিগঞ্জে ষাট-সত্তরটা বছর কাটিয়ে মাথার চুল পাকিয়ে ফেললুম, তবু আমিই এখনও কত কথা বুঝতে পারি না, আর তুমি তিনদিনের ছোঁকরা, সব বুঝে ফেলবে? মোতিগঞ্জ জায়গাটা অত সোজা নয় রে বাপু। এখানে খুব হিসেব কষে থাকতে হয়। এমনিতে বাইরে থেকে দেখে মনে হবে বুঝি বেশ নিরিবিলি, নির্ঝঞ্ঝাট, ঠাণ্ডা, সুন্দর একখানা শহর। কিন্তু যত এখানে থাকবে তত বুঝবে যে, এখানে চারদিকে খুব শক্ত-শক্ত আঁক।”