“পাগল! গোপাল তা হলে কি আমাকে আস্ত রাখবে? তোমাকে বাড়ি অবধি এগিয়ে দিয়ে তবে আমার ছুটি।”
হরি বুঝল, গোপালের আদেশ এ-ছেলেটার কাছে গুরুর আদেশের মতো। সেই আদেশ পালন না করে ওর উপায় নেই।
হরি হেসে বলল, “চলো তা হলে, গল্প করতে করতে যাই।”
দু’জনে গল্প করতে করতে হাঁটতে লাগল। বেশির ভাগই স্কুলের কথা, ছেলেদের কথা, নিজেদের কথা।
তেঁতুলতলার কালীবাড়ি ছাড়িয়ে বাঁ দিকে সাহেবপাড়ার মোড়ের কাছবরাবর ইউক্যালিপটাস আর শালগাছে ভরা এক টুকরো জমি আছে। শীতের অপরাহ্নে সেখানে গাঢ় ছায়া জমে আছে। সেই জমিটার পাশ দিয়ে যখন দু’জনে যাচ্ছে তখন আচমকা সাত-আটটা ছেলে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে তাদের ঘিরে ফেলল চোখের পলকে। আর তারা কিছু বুঝে ওঠবার আগেই টানতে টানতে জঙ্গলটার মধ্যে নিয়ে গেল।
হরি দেখল, এদের মধ্যে রাজর্ষি আর থ্রি ম্যাক্সেটিয়ার্স তো আছেই, আরও গোটাকতক বেশ বেশি বয়সের কেঁদো-কেঁদো চেহারার অচেনা ছেলে রয়েছে। প্রত্যেকের হাতেই রড বা লাঠি গোছের অস্ত্র। রাজর্ষির হাতে ঝকঝক করছে একটা ড্যাগার।
রাজর্ষি হাত বাড়িয়ে বলল, “গোপালের চিঠিটা দেখি।”
হরি এত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল যে, জবাব দিতে ভুলে গেল। রাজর্ষি চড়াত করে তার গালে একটা চড় কষিয়ে বলল, “কাল তো খুব তেজ দেখিয়ে গিয়েছিলে! ভেবেছিলে আমরা ভেড়ুয়া? এখন তো আর গোপাল নেই যে, সাহস দেখাবে! চিঠিটা ভালয়-ভালয় বের করে দাও।”
হরি অঙ্ক বই খুলে চিঠিটা বিনা বাক্যব্যয়ে বের করে দিল। রাজর্ষি চিঠিটা পড়ে অন্য একটা ছেলের হাতে দিয়ে হরির দিকে চেয়ে বলল, “তোমার সঙ্গে গোপালের কী কী কথা হয়েছে?”
হরি অবাক হয়ে বলল, “রোজ তোমরা গোপালের কথা জানতে চাও কেন? তার সঙ্গে তো আমার সবে একটু ভাব হয়েছে। এখনও তাকে আমি ভাল করে চিনিও না।”
রাজর্ষি তার দিকে স্থির চোখে চেয়ে বলল, “গোপালকে আমরা চিনি। বিশেষ কারণ না থাকলে সে সহজে কারও সঙ্গে ভাব করে না। তোমার সঙ্গে যখন ভাব করেছে, তখন কারণও একটা নিশ্চয়ই আছে। আমরা সেই কারণটা জানতে চাই।”
হরি অসহায় ভাবে মাথা নেড়ে বলল, “আমিও কারণটা জানি না। আর কাল রাতে তোমরা যখন কুসুমকুঞ্জে ওকে মেরেছিলে, তখন ও অজ্ঞান হয়ে যায়। অজ্ঞান অবস্থায় কথা বলবে কী করে?”
একথায় সকলেই স্থির হয়ে গেল। রাজর্ষি গলায় একটা বাঘের মতো গর্জন ছেড়ে বলল, “কাল রাতে ওকে আমরা মেরেছি একথা কে বলল?”
“তোমরা ছাড়া আর কে মারবে?”
পটাং করে কার একটা লাঠির ঘা এসে পড়ল হরির বাঁ কাঁধে। যন্ত্রণায় ‘ওফ’ বলে একটা শব্দ করে সে মাটিতে উবু হয়ে বসে পড়ল। টুলুও চেঁচিয়ে উঠল, “মেরে ফেলল! বাঁচাও।”
তারপর কী হল কে জানে! চারদিক থেকে ছেলেগুলো ঠকাঠক লাঠি আর রড চালাতে লাগল। হরির কোমরে একটা জুতোসুদু পায়ের লাথিও এসে লাগল জোরে। সে মাটিতে পড়ে যেতেই দেখল, একটা ছেলে মস্ত রড় তুলেছে তার মাথা লক্ষ্য করে।
ভয়ে চোখ বুজে ফেলল হরি।
আর চোখ বুজেই শুনতে পেল, কোথা থেকে যেন একটা দ্রুতগামী তেজী ঘোড়া দৌড়ে আসছে। মাটিতে টগবগ শব্দ হচ্ছে তার পায়ের। ঝড়ের মতো বনবাদাড় ভেঙে এসে পড়ল কাছে। খুব কাছে।
আর্তস্বরে কারা যেন একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল “পাগলা-সাহেব! পাগলা-সাহেব!”
তারপরেই ভোজবাজির মতো কে কোথায় মিলিয়ে গেল কে জানে!
৬. খানিকক্ষণ শুয়ে থেকে
খানিকক্ষণ শুয়ে থেকে ভাল করে দম নিল হরি। তারপর ধীরে-ধীরে উঠে বসল। অদূরে একটা গাছের গোড়ায় টুলুর রোগা শরীরটা নেতিয়ে পড়ে আছে।
হরি গিয়ে টুলুকে নাড়া দিয়ে ডাকল, “এই টুলু, টুলু, তোমার কি খুব লেগেছে?”
টুবলুও ধীরে ধীরে উঠে বসল। মুখে ক্লিষ্ট একটু হাসি। বলল, “লেগেছে তো ভাই খুব। মুখে একটা ঘুসি মেরেছিল জোর। কিন্তু আরও সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড হতে পারত। পাগলা-সাহেবের জন্য বেঁচে গেছি।”
গায়ের ধুলো ঝেড়ে দু’জনে উঠে দাঁড়ানোর পর হরি জিজ্ঞেস করল, “এই পাগলা-সাহেব কে বলো তো!”
টুলু মাথা নেড়ে বলল, “জানি না।”
“লোকটা মানুষ, না ভূত?”
“তাও জানি না। শুধু জানি, মাঝে-মাঝে পাগলা-সাহেব দেখা দেয়।”
“তা হলে আর-একটা কথার জবাব দাও। পাগলা-সাহেবের কবর বলতে এখানে কিছু আছে কি?”
টুবলু মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক বলতে পারব না। তবে শুনেছি, এরকম নামের একটা কবর কোথাও আছে। তবে সেটা কোথায় তা কেউ জানে না।”
“সেই কবরের কোনও মাহাত্ম্য আছে কি?”
টুলু মাথা নেড়ে বলল, “জানি না। তবে শুনেছি, কবর থেকে পাগলা-সাহেবের কফিনটা যদি কেউ তুলে ফেলতে পারে তবে আর মোতিগঞ্জে পাগলা-সাহেবকে কখনও দেখা যাবে না। আর…”
টুবলু হঠাৎ চুপ করে যাওয়ায় হরি বলল, “আর কী?”
“পাগলা-সাহেবের গলায় একটা মুক্তো বসানো সোনার ক্রস আছে। সেটার দাম লাখ-লাখ টাকা।”
হরি একটু চুপ করে থেকে বলল, “তাই বলো।”
টুবলু মুখের রক্ত হাতের পিঠে মুছে নিয়ে বলল, “তোমার খুব লাগেনি তো!”
“না। মাস্টারমশাইদের বেত খেয়ে-খেয়ে আমার হাড় পেকে গেছে। শোনো, তোমাকে আর আমার সঙ্গে যেতে হবে না। তুমি বাড়ি ফিরে যাও। এটুকু আমি একাই যেতে পারব।”
টুবলু বলল, “আচ্ছা।” তারপর দুজনে দুজনের কাছে বিদায় নিল।
বাড়ি ফিরে এসে হরি হাতমুখ ধুয়ে ব্যথার জায়গায় একটু মলম ঘষল। বাঁ কাঁধটা ফুলে শক্ত হয়ে উঠেছে। কোমরটাও টনটন করছে। কিন্তু প্রবল মানসিক উত্তেজনায় সে শরীরের ব্যথা তেমন টের পাচ্ছিল না।