“এসো। এর বাড়িতে একটা খবর দিও।” পটল দাস রাজি হয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
হরি ঠায় বসে রইল গোপালের পাশে।তারপর একসময়ে ঢুলুনি এসে গেল তার। চোখ বুজে ফেলল। তারপর আর কিছু মনে রইল না।
৫. চোখে রোদ লাগায়
চোখে রোদ লাগায় ধড়মড় করে উঠে নড়েচড়ে বসল হরি। তারপর অবাক হয়ে দেখল, বিছানাটা খালি। গোপালের চিহ্নও নেই। তবে বালিশে রক্তের দাগ লেগে আছে। টেবিলের ওপর গোপাল দাসের দুটো ওষুধের শিশি পাশাপাশি ভাইবোনের মতো দাঁড়িয়ে।
তাড়াতাড়ি উঠে বাথরুমটা দেখল হরি। নেই। বারান্দা এবং আশেপাশে বাগানেও খুঁজল। নেই। কিন্তু ওই অবস্থায় গোপালের পক্ষে খুব বেশি দূরেও তো যাওয়া সম্ভব নয়।
দরোয়ান জগুরাম বাড়িতে ছিল না। ঝুমরি ছিল। রোদে ছোট একটা খাঁটিয়ায় একটা বাচ্চাকে শুইয়ে তেল মাখাচ্ছিল। তাকে জিজ্ঞেস করায় কিছুক্ষণ বোবার মতো চেয়ে থেকে মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে বলল, সে কাউকে দেখেনি।
রাস্তাটাও একটু ঘুরে দেখে এল হরিবন্ধু। কেউ কোথাও নেই।
ঘরে এসে চুপচাপ বসে কিছুক্ষণ স্থির মস্তিষ্কে ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখল সে। কিন্তু সমাধান ভেবে পেল না।
স্কুলের সময় হয়ে এসেছিল বলে অগত্যা উঠতে হল হরিবন্ধুকে। খুবই অন্যমনস্ক ভাবে সে বরফের মতো ঠাণ্ডা জলে স্নান করল। তেমনি আনমনেই ঝুমরির বেড়ে-আনা এক-পাহাড় ভাত খেয়ে নিল। কিন্তু সারাক্ষণ সে ভাবতে লাগল, কাল রাতে সে কি স্বপ্ন দেখেছিল? যদি স্বপ্ন
হয়ে থাকে তবে গোপালকে কারা এবং কেন মারল? পাগলা-সাহেব বলে একজন কেউ এখানে আছে, যার কথা গোবিন্দদা তাকে বলেছে, গোপালও বলেছে, তবে তার আবার কবর কী করে থাকবে! আর সেই কবর খুঁজছেই বা কারা! পটল দাস লোকটা আসলে কে!
ভাবতে ভাবতে পোশাক পরে বইখাতা নিয়ে সে সাহেবপাড়ার নির্জন রাস্তা দিয়ে স্কুলের দিকে হাঁটতে লাগল। পাশের বাড়ির দিকে অনিবার্যভাবেই তার চোখ চলে গেল। কাল রাতের ঘটনাস্থল। দিনের বেলা ভাল করে দেখল হরি। একসময়ে বিশাল ফুলের বাগান ছিল, পাথরের ফোয়ারা ছিল, পরী ছিল। এখন বাগান জঙ্গলে ছেয়ে গেছে। পরীর দুটো ডানাই ভাঙা। ফোয়ারা কাত হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। বাড়িটাও বিশাল। কিন্তু নোনা ধরে, শ্যাওলা পড়ে, অশ্বথগাছ গজিয়ে বাড়িটার বারোটা বেজে যাচ্ছে। ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখল হরি। দেখতে দেখতে হঠাৎ ফটকের গায়ে শ্বেতপাথরে খোদাই করা নামের ফলকটা চোখে পড়ল তার। সাদার ওপর কালো অক্ষরে লেখা, ‘কুসুমকুঞ্জ’।
হরি একটু শিউরে উঠল। গোপাল তাকে কুসুমকৃঞ্জের কথা বলেছিল বটে।
সে আর দাঁড়াল না। তাড়াতাড়ি স্কুলের দিকে হাঁটা দিল। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
স্কুলে এসে দেখল, গোপালের জায়গাটা ফাঁকা, ফাঁকাই থাকার কথা। তবু মনটা খারাপ হয়ে গেল। ছেলেটা যে কোথায় গায়েব হল, কে জানে! যারা রাতে গোপালকে মেরেছিল তারাই গুম করে নিয়ে যায়নি তো! আজ ক্লাসে রাজর্ষি বা থ্রি মাক্সেটিয়ার্সকে দেখতে পাওয়া গেল না। তাতে একটু স্বস্তিই বোধ করল হরি।
ফার্স্ট পিরিয়ড শুরু হওয়ার মুখে শেষ বেঞ্চের একটা ছেলে হঠাৎ এসে তার হাতে একটা ভাঁজ করা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে গেল। হরি কাগজটার ভাঁজ খুলে দেখল, তাতে লেখা: তুমি যে কাল রাতে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ সেকথা আমি ভুলব না। আমি এখন ভাল আছি। তবে কয়েক দিন স্কুলে যাওয়া হবে না। সকালে যখন ঘুম ভাঙল, তখন তুমি ঘুমোচ্ছিলে। আমি তোমাকে ডাকিনি। পাছে আমাকে নিয়ে তুমি ঝামেলায় পড়ো সেই ভয়ে চলে এসেছি। চিন্তা কোরো না। একটা ইটের ঘায়ে কাবু হওয়ার ছেলে গোপাল নয়। দেখা হলে সব বলব। একটা কথা বলে রাখি, কুসুমকুঞ্জের ভিতরে ভুলেও যেও না। তোমার ভালর জন্যই বলছি।
চিঠিটা ভাঁজ করে অঙ্ক বইয়ের মধ্যে রেখে একটা নিশ্চিন্তের শ্বাস ফেলল হরি। গোপালের জন্য তবে চিন্তার তেমন কিছু নেই।
আজও ক্লাসে কেউ তাকে বিন্দুমাত্র বিরক্ত করছিল না। কিন্তু সারাক্ষণই হরি খুব অস্বস্তির সঙ্গে টের পাচ্ছিল, অলক্ষ্যে কে যেন তার দিকে বিষদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে সে সকলের চোখের দিকে চেয়ে দেখছিল। কিন্তু কে যে অমনভাবে তার দিকে তাকাচ্ছে, তা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না। কিন্তু তাকানোটা এমনই মারাত্মক যে, আঙুলের স্পর্শের মতো টের পাচ্ছিল সে।
ভালয়-মন্দয় ক্লাসগুলো কেটে গেল। স্কুল থেকে বেরিয়ে বাঁয়ে মোড় নিতেই মস্ত শিমুলগাছটার আড়াল থেকে একটা ছেলে বেরিয়ে এসে বলল, “আমি টুলু। গোপাল আমার বন্ধু।”
ছেলেটাকে হরিও চিনল। গোপালের চিঠিটা ওই এনে দিয়েছে তাকে। রোগা, ফর্সা চেহারা। দেখলে মনে হয় নিতান্তই নিরীহ।
হরি উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল, “গোপাল এখন কেমন আছে?”
টুবলু ঠোঁট উলটে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব দেখিয়ে বলল, “গোপাল কত মার খেয়েছে, ওর কিছু হয় না ওতে। দু’দিনেই ঠিক হয়ে যাবে।”
“তুমি কি ওর বাড়ির কাছে থাকো?”
“হ্যাঁ। আমাদের পাশাপাশি বাড়ি। শোনো, আমি কিন্তু গোপালের মতো সাহসী নই। গোপাল আমাকে বলেছে, যেন তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। কিন্তু আগেই বলে রাখছি, বিপদ-টিপদ হলেই আমি পালাব।”
হরি মৃদু হেসে বলল, “আমাকে পৌঁছে দেওয়ার কোনও দরকার নেই তোমার। বিপদ কিছু হবে না। আর হলেও আমি অত ভয় পাই না। তুমি বাড়ি যাও।”