দেওয়ালটা দু’জনে ডিঙোল। আগে পটল, পিছনে হরি।
পটল সাবধান করে দিয়ে বলল, “খবরদার, টর্চ জ্বেলোনা। টর্চ খুব খারাপ জিনিস। আমার পিছু-পিছু এসো। চোখে ছানি হলে কী হয়, অন্ধকারেও সব ঠাহর করতে পারি।”
ঘাসজমি ডিঙিয়ে ঝোঁপটার কাছে পৌঁছে পটল বলল, “এইখানে।”
বেশি খুঁজতে হল না। গোলাপ-ঝোঁপের ভিতর থেকে দু’খানি পা বেরিয়েই ছিল। পটল আর হরি টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনল লোকটাকে। জ্যোৎস্নার ফিকে আলোতেও হরি মুখোনা চিনতে পেরে আর্তনাদ করে উঠল, “সর্বনাশ।”
পটল পট করে তার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, “আস্তে। চেঁচালে বিপদে পড়বে। তা লোকটা কে?”
“ও হল গোপাল। আমরা এক ক্লাসে পড়ি।”
পটল ভ্রূ কুঁচকে বলল, “এত অল্প আলোয় ঠিক চিনতে পারছি না। কোন্ গোপাল বলো তো। সেই ঝিকু সর্দারের ছেলেটা নাকি?”
“আমি ঝিকু সর্দারকে চিনি না। তবে গোপালকে সবাই ভয় পায়।”
পটলের ভু সটান হয়ে গেল, “তা হলে ঠিকই ধরেছি। ঝিকুরই ছেলে। তা বেঁচে আছে নাকি?”
গোপাল বেঁচেই ছিল। তবে জ্ঞান নেই। মাথার পিছন দিকটা থেঁতলে গিয়ে রক্তে একেবারে ভাসাভাসি কাণ্ড। মাঝে বোধহয় জ্ঞান একটু ফিরেছিল। তখনই ককিয়ে উঠেছিল যন্ত্রণায়।
হরি সভয়ে বলল, “এখন কী হবে পটলদা?”
পটল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঝিকুর ছেলের গায়ে হাত তোলা
যার-তার কর্ম নয়। একটু আগেই বলছিলে না, সবাই ওকে ভয় পায়। তা ভয় ওকে সাধে পায় না। তবে ওকে নয়, ভয় ওর বাপকে। এখন এই কাণ্ডের পর ঝিকু ক’টা লাশ নামায়, দ্যাখো। দশ বছর আগে হলে ঝিকুর হাতে বিশ-পঞ্চাশটা খুন হয়ে যেত। এখন অত হবে না। কিন্তু কত হবে তা এখনই বলতে পারছি না। আমি বলি কি, এইবেলা পালাও।”
“কিন্তু এ যে আমার বন্ধু।”
“তা বটে, কিন্তু ঝিকু…”। “তখন থেকে কেবল ঝিকু-ঝিকু করছ কেন? ঝিকুটা কে?”
“এ-তল্লাটে যখন এসে পড়েছ তখন চিনবেই একদিন। আমি পাপমুখে সব বলি কেন? বন্ধুকে যদি ফেলে যেতে না চাও, তবে চলো ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে তোমার ঘরেই তুলি।”
তাই হল। দু’জনে ধরাধরি করে গোপালকে নিয়ে ভাঙা পাঁচিল পেরিয়ে হরির ঘরে এনে তুলল।
হরি বলল, “কিন্তু রক্তে যে ভেসে যাচ্ছে। একজন ডাক্তার ডাকলে হয়? এত হেমারেজ হলে তো মরে যাবে। রক্তটা এখনও ক্লট বাঁধেনি। হেমাটোমো…”
পটল চোখ বড় বড় করে হরির কথা শুনছিল। হঠাৎ বলল, “তুমি কি ডাক্তারের ছেলে?”
“কী করে বুঝলে?”
“অনেক জানো দেখছি। তবে ভয় নেই। আমাকে সবসময়ে ওষুধ-বিষুধও রাখতে হয়। তবে টোটকা।”
বলেই পটল পোশাকের ভিতরে কোথায় হাত ভরে একটা শিশি বের করে আনল। তাতে খানিকটা কালচে তেল। যত্ন করে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিল। আর-একটা শিশি বের করে হরির হাতে দিয়ে বলল, “খুব যন্ত্রণা হলে ছিপিটা খুলে একটু শুকিয়ে দিও। ওতেই কাজ হবে।”
হরি ডাক্তারের ছেলে বলেই তার সঙ্গে তুলো ব্যাণ্ডেজ ওষুধ থাকে। গোপালের মাথা ব্যান্ডেজে নিপুণ হাতে বেঁধে সে শিশিটা নিয়ে ছিপি খুলে একটু শুকে দেখল। চন্দন, গোলাপের আতর এবং আরও কিছু সুবাস-মেশানো একটা মাদক গন্ধ। সে অবাক হয়ে বলল, “এ তো স্মেলিং সল্ট নয়! তবে এটা কী?”
পটল মাথা নেড়ে বলল, “ডাক্তারি ওষুধ ছাড়াও দুনিয়ায় মেলা ওষুধ আছে। ওসব গুপ্তবিদ্যের খবর ডাক্তাররা জানেও না। এ হল কালী কবরেজের মুষ্টিযোগ। ওর নাকে একটু ধরেই দেখ না, কী হয়।”
আশ্চর্যের বিষয়,শিশির মুখটা গোপালের নাকের কাছে ধরার কিছুক্ষণ পরেই ধীরে-ধীরে গোপাল চোখ মেলে চাইল। দৃষ্টিটা ঘোলাটে, অস্বচ্ছ। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর চোখ স্বাভাবিক হয়ে এল। উদভ্রান্তের মতো সে চারদিকে চেয়ে দেখে নিয়ে ক্ষীণ গলায় বলে উঠল, “ওরা পাগলা-সাহেবের কবর খুঁজছে।”
হরি গোপালের ওপর ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, “কারা? কী খুঁজছে?”
পটল দাস চাপা গলায় বলে উঠল, “সর্বনাশ!”
গোপাল একবার উঠে বসবার চেষ্টা করল। কিন্তু প্রচুর রক্তক্ষরণে সে সাঙ্ঘাতিক দুর্বল। তার ওপর মাথায় চোটটাও বেশ জোরালো রকমের। উঠবার চেষ্টা করতে গিয়ে ফের লুটিয়ে পড়ল বিছানায়।
হরি আবার তাকে শিশি শোঁকাতে যাচ্ছিল। পটল তার হাতটা ধরে বাধা দিয়ে বলল, “থাক। এখন ওকে ঘুমোতে দাও।”
হরি জিজ্ঞেস করল, “গোপাল কী সব বলল বলো তো! পাগলা-সাহেবের কবর না কী যেন!”
পটল খুব অবাক হয়ে বলল, “কই, আমি তো কিছু শুনতে পেলুম না! আমার কান সেই কখন থেকে ভোঁ-ভোঁ করছে, পরশু কানে একটা শ্যামাপোকা ঢুকেছিল তো!”
“কিন্তু এতক্ষণ তো আমার কথা দিব্যি শুনতে পাচ্ছিলে!”
“তা বটে। কিন্তু পোকাটা এই একটু আগে কানের মধ্যে নড়াচড়া শুরু করেছে। উরে বাবা, যাই, কানে একটু গরম তেল দিই গে।”
পটল দাস যে কিছু একটা চেপে যেতে চাইছে তা বুঝতে কষ্ট হল না হরির। তবে এই অবস্থায় সে আর এ-নিয়ে কথা বাড়াতে চাইল না। শুধু বুঝল, কেউ বা কারা পাগলা সাহেবের কবর খুঁজছে, এই হল মোদ্দা কথা। এটা খুব একটা সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার বলেও তার মনে হল না। সে পটল দাসের দিকে চেয়ে বলল, “আমাকে পাঁচ শেখাবে বলেছিলে, মনে আছে তো! তার বদলে আমি তোমাকে লেখাপড়া শেখাব।”
পটল ঘাড় কাত করে বলল, “খুব মনে আছে। তবে দিনের বেলা আমার সুবিধে হবে না। রাতবিরেতে চলে আসব’খন। ভোর হয়ে আসছে, এবার গিয়ে আমাকে গর্তে ঢুকে পড়তে হবে। আসি গে।”