হরি ধৈর্য হারিয়ে বলল, “কিন্তু কী দেখলে সেটা বলবে তো?”
“দেখলুম যেন ওই গোলাপ-ঝোঁপটার কাছে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। মতলব নিশ্চয়ই ভাল ছিল না। দাঁড়িয়ে কী যেন দেখছিল বাড়িটার দিকে চেয়ে। এমন সময় আর-একটা লোক যেন মাটি খুঁড়ে লোকটার পিছন দিকে উদয় হল। তারপর প্রথম লোকটার মাথায় একটা ইট তুলে দড়াম করে বসিয়ে দিল। লোকটা একটাও শব্দ করতে পারেনি। কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেল। তখন দ্বিতীয় লোকটা তার পা ধরে হেঁচড়ে নিয়ে গোলাপ-ঝোপে লাশটা ঢুকিয়ে দিয়ে কোথায় হাওয়া হল। বুড়ো বয়সে এখন ঠিক আর এগিয়ে যেতে সাহস পেলুম না। খুন যদি হয়ে থাকে তবে সাক্ষী থাকাটাও বিপদের কথা।”
হরি উত্তেজিত হয়ে বলল, “ও বাড়িতে কে থাকে?”
“কেউ না। বুড়ো অবিনাশ ভদ্র ছিল। তা সেও গতবারে মরে গেল। ওয়ারিশও কেউ নেই। বাড়ি ফাঁকা পড়ে থাকে।”
“দরোয়ান?”
“নাঃ। দরোয়ানের মাইনে দেবে কে? বললুম না ওয়ারিশই নেই।”
হরি বলল, “কিন্তু আমাদের তো ব্যাপারটা দেখা উচিত।”
পটল দাস মাথা নেড়ে বলল, “ওরে না রে বাবা, না। হুট করে কিছু করে বসতে নেই। তার ওপর আমার ছানিপড়া চোখে কী দেখতে কী দেখেছি তারই ঠিক কী? এই তো সেদিন দেখলুম পুকুরের ধারে দিব্যি এক রামধনু উঠেছে। নাতিকে ডেকে দেখাতে গেলুম, তা সে বলল, রামধনুটনু কিছুই নাকি নেই। আমি ভুল দেখেছি।”
“ভুল দেখেছ কি না সেটাও তো দেখা দরকার।”
পটল দাস মাথা নেড়ে বলল, “ন্যায্য কথা। কিন্তু ভয়টাও সেখানেই। যদি ভুল না দেখে থাকি, তবে লাশের কাছে যাওয়াটা উচিত নয়।”
“কিন্তু লোকটা তো না-ও মরে গিয়ে থাকতে পারে।”
“তা বটে।”
“এখনও তুলে নিয়ে মুখে জলটল দিলে বেঁচে যাবে হয়তো। কিন্তু সারা রাত হিমের মধ্যে পড়ে থাকলে মরেই যাবে।”
“সেও ঠিক কথা। কিন্তু আমার কেমন যেন সাহস হচ্ছে না।”
হরি এবার একটু গরম হয়ে বলল, “যখন চুরি করে বেড়াও, তখন ভয় করে না? এখন ভয় করলে চলবে কেন?”
পটল দাস এবার চোখ পাকিয়ে বলল, “চুরি মানে কেবল চুরিই? সেটা কি আর্ট নয়? আর আমাকে ছিচকে চোর পেয়েছ? পটল দাস কখনও ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করে না, মনে রেখো।”
“আমি কালই রটিয়ে দেব যে, তুমি চুরি করতে এসে আমার কাছে ধরা পড়ে গেছ।”
একথায় পটলের চোখ কপালে উঠল। বলল, “ও বাবা, তুমি যে বেশ পাজি তোক দেখছি। পটল দাস এখনও ধরা পড়েনি জীবনে, তা জানো? কেউ তোমার কথা বিশ্বাস করবে না।”
“খুব করবে। এক্ষুনি তোমাকে জাপটে ধরে ‘চোর, চোর’ বলে চেঁচালে জগুরাম আর তার বউ দৌড়ে আসবে। তারপর ঘরে পুরে তালা দিয়ে রাখব। সকালে সবাই এসে দেখবে।”
একথায় পটল দাস খকখক করে হায়েনার হাসি হাসল। তারপর বলল, “জাপটে ধরবে? বটে! তা ধরার চেষ্টা করে দ্যাখো তো কী হয়।”
“কেন, মারবে নাকি? আমার গায়ে মেলা জোর তা জানো? পড়াশুনোয় তেমন ভাল না হতে পারি, কিন্তু গায়ের জোরে কম নই।”
“থাক, অত বড়াই করতে হবে না। তোমার চেয়ে ঢের-ঢের জোয়ান পালোয়ান দেখেছি। পটল দাসের বয়স হয়েছে বটে, কিন্তু বিদ্যে তো মরেনি। এখনও অনেক ভোজবাজি দেখাতে পারি। দেখি না কেমন জাপটে ধরে রাখতে পারো। এসো দিকি পালোয়ানচন্দর।”
হরি এই ছোটখাটো বুড়োসুড়ো লোকটার কথা শুনে না-হেসে পারল না। একে ধরা নাকি আবার একটা ব্যাপার? সে চোখের পলকে দু হাতে জাপটে ধরল পটল দাসকে।
ধরল বটে, কিন্তু ভারী অবাক হয়ে দেখল, পটল দাসের বদলে সে ধরেছে খানিক হাওয়া বাতাসকেই। পটল তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে ফিকফিক করে হাসছে। হরি ব্যাঙের মতো একখানা লাফ দিয়ে গিয়ে একেবারে ঘাড়ের ওপর পড়ল পটলের। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, পটলও হুবহু ওরকমই একখানা লাফ মারল সঙ্গে-সঙ্গে, এবং ভোজবাজির মতো চার হাত তফাত হয়ে গেল দু’জনের মধ্যে।
হরি হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “তুমি ভূত নও তো?”
পটল দাস ফিক করে হেসে বলল, “তা ভূতও বলতে পারো। ভূত মানে অতীত। আমার কি আর সেই দিনকাল আছে? বেঁচে থেকেও মরা। তা হলে বুঝলে তো আমাকে ধরা অত সহজ নয়?”
হরি বোকার মতো মাথা নেড়ে বলল, “বুঝেছি। যদি সত্যিই ভূত না হয়ে থাকো, তবে বলতেই হয়, তুমি বেশ ওস্তাদ লোক।”
পটল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এ আর কী দেখছ? আরও কত কী শিখেছিলাম। হস্তলাঘব, মুখবন্ধন, বায়ু-নিয়ন্ত্রণ, কুম্ভক। কোথাও কাজে লাগল না। প্যালারামকে শেখানোর ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ওর মায়ের জন্যই হল না। সে বলল, না, ছেলে তোমার মতো চোর হবে না।”
“আমাকে শেখাবে?”
“তুমি? তুমি শিখে কী করবে?”
“চুরি করব না। তবে শিখে রাখব।”
“শেখাতে পারি, তবে শর্ত আছে।”
“কী শর্ত?”
পটল বেশ লজ্জার সঙ্গে ঘাড় চুলকে বলল, “লেখাপড়া শিখিনি বলে আমাকে বড় হেনস্থা করে লোকে। ছেলেবউও বড্ড গঞ্জনা দেয়। তা আমার বড় ইচ্ছে, লেখাপড়া শিখে ওদের জব্দ করি। শেখাবে?”
“শেখাব।”
কথাবার্তায় হঠাৎ বাধা পড়ল। ভদ্রবাবুদের বাগান থেকে হঠাৎ একটা ক্ষীণ আর্তনাদের শব্দ এল।
দু’জনেই স্তব্ধ হয়ে শুনল। তারপর পটল বলল, “পালাও, ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো গে। আমিও এই বেলা সরে পড়ি।”
“কিন্তু পটলদা, ব্যাপারটা না দেখে পালানোটা কি ঠিক হবে?”
“ওঃ, তুমি জ্বালালে দেখছি। আচ্ছা, চলো। বেগতিক দেখলে আমি কিন্তু সরে পড়ব।”