- বইয়ের নামঃ পাগলা সাহেবের কবর
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. গগন-ডাক্তারের বড় ছেলে
পাগলা সাহেবের কবর – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
গগন-ডাক্তারের বড় ছেলে হরিবন্ধু যে একটি গবেট তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্রত্যেক ক্লাসেই এক-আধবার করে ঠেকে ঠেকে ক্লাস সেভেনে উঠে সেই যে সে অ্যালজেবরা, জিওমেট্রি, গ্রামার আর সংস্কৃতের বেড়াজালে পড়ে গেল, আর সেই জাল কেটে বেরোতেই পারে না। সেভেনেই তার বয়স তিন বছর আরও বেড়ে গেল। ছোট ভাই-বোনেরা পটাপট তাকে ডিঙিয়ে ওপরের ক্লাসে উঠে যেতে লাগল। হরির গোঁফের রেখা দেখা দিল, গালে উঠে পড়তে লাগল দাড়ি।
গগনবাবু খুবই শান্ত ও ধৈর্যশীল মানুষ। তাঁর তিন ছেলে আর দুই মেয়ের মধ্যে হরিকে বাদ দিলে আর কেউই তেমন ফেলনা নয়। আহামরি না হলেও সকলেই ভাল নম্বর পেয়ে ফি বছর নতুন ক্লাসে ওঠে। মেজো ছেলে খেলাধুলোয় ভাল, দু’মেয়েরই গানের গলা চমৎকার। ছোট ছেলে বেশ সুন্দর ছবি আঁকতে পারে। হরি শুধু গবেট নয়, তার আর কোনও গুণই আছে বলে মনে হয় না।
সে তিনবার সেভেনে ফেল করার পর হেডমাস্টারমশাই নলিনীকান্ত রায় একদিন গগনবাবুকে ডেকে খুব ভদ্রভাবেই বললেন, “ডাক্তারবাবু, আপনি শহরের গণ্যমান্য লোক বলেই হরিবন্ধুকে এই স্কুলে এতদিন রেখেছি। আমরা এমনিতে ফেল করা ছাত্রকে রাখি না। হরিবন্ধুর জন্য এবার আপনাকে অন্য ব্যবস্থা করতেই হবে। নইলে স্কুলের রেকর্ড খারাপ হচ্ছে, ব্যাড প্রেসিডেন্স তৈরি হচ্ছে। আমরা ওকে এবারই টি সি দেব, স্কুল অথরিটি আমাদের সেবকমই অডার দিয়েছে।”
লাল টকটকে মুখ নিয়ে গগনবাবু তাঁর চেম্বারে ফিরে এলেন। চেম্বারে তখন অনেক রোগী অপেক্ষা করছে। কিন্তু গগনবাবু রাগে দুঃখে ক্ষোভে এমনই বিমনা হয়ে পড়েছেন যে, একজন রোগীর পেট টিপে পরীক্ষা করতে গিয়ে এমন আঙুলের খোঁচা দিলেন যে, সে ‘আঁক’ করে উঠল। আর-একজনের প্রেশার মাপতে গিয়ে এমন পাম্প করলেন যে, সেই রোগীর হাতে ঝিঁঝি ধরে গেল।
দুখিরামবাবুও গগনবাবুর রোগী। বিচক্ষণ প্রবীণ মানুষ। নামে দুখিরাম হলেও তিনি বিরাট বড়লোক। আট-দশরকমের ব্যবসা আছে। তিনি বিদেশেও মাল চালান দেন। এতক্ষণ তিনি চুপচাপ বসে ছিলেন। গগনবাবুর ভাবসাব দেখে তাঁর ভাল ঠেকল না। তাই তিনি তাঁর পালা এলে খাস চেম্বারে ঢুকে পড়ে গগনবাবুকে বললেন, “আপনার কি আজ মেজাজটা ভাল নেই?”
গগনবাবু দুখিরামবাবুকে খুবই খাতির করেন। অন্য কেউ এ-প্রশ্ন করলে চটে যেতেন। দুখিরামবাবুর ওপর চটলেন না। মস্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “কী আর বলব। আমার বড় ছেলেটা বড়ই গবেট। তিনবার ফেল করেছে। স্কুল থেকে টি সি: দিচ্ছে। কী যে করি।”
দুখিরামবাবু স্থিরভাবে বসে বললেন, “সবটা খুলে বলুন। দ্বিধা করবেন না।”
গগনবাবু বললেন, দুখিরামবাবু শুনলেন।
শুনে একটি মাত্র প্রশ্ন করলেন, “আপনি কি এ-বিষয়ে নিশ্চিত যে, আপনার বড় ছেলে হরিবন্ধুর কোনও গুণই নেই?”
“থাকলে এতদিনে টের পেতাম।”
“মা বাপেরা অনেক সময়ে দোষ-গুণ কোনওটাই টের পায় না। তা সে যাকগে। আপনি মোতিগঞ্জের নাম শুনেছেন?”
“না। সেটা কোথায়?”
“সাঁওতাল পরগনায়। বেশ স্বাস্থ্যকর জায়গা। তার চেয়ে বড় কথা, সেখানে চারুবালা বেঙ্গলি স্কুল বলে একটা স্কুল আছে। তার খুব নাম-ডাক।”
গগনবাবু হতাশার গলায় বললেন, “নাম-ডাকওয়ালা স্কুল আমার গবেট ছেলেকে নেবে কেন?”
“নেবে। তার কারণ ওই স্কুলের নাম-ডাক গাধা পিটিয়ে ঘোড়া বানানোর জন্যই। একসময়ে সারা দেশের গবেট ছেলেরা ঝেটিয়ে আসত ওই স্কুলে পড়তে। এখন ততটা নয়। হোস্টেলও একটা ছিল, কিন্তু এখন তত ছাত্র হয় না বলে হোস্টেল তুলে মাস্টারমশাইদের কোয়ার্টার বানানো হয়েছে। তবে তাতে কোনও অসুবিধে নেই। মোতিগঞ্জে আমার একটা কারবার আছে। স্বাস্থ্যকর জায়গা বলে হালে সেখানে একখানা পুরনো বাড়িও কিনেছি। গৃহপ্রবেশ করারও সময় পাইনি। আপনার ছেলে দিব্যি সেই বাড়িতে থাকতে পারবে। দরোয়ান আছে, সে দেখাশোনা করবে, দরোয়ানের বউ দু’বেলা বেঁধে দেবে। কোনও অসুবিধে হবে না। ভেবে দেখুন, যদি রাজি থাকেন তবে আমাকে জানাবেন।”
এই বলে দুখিরামবাবু উঠলেন। আজ আর গগন-ডাক্তারকে নাড়ি দেখাতে তাঁর সাহস হল না। ডাক্তারের মুখ এখনও রক্তবর্ণ হয়ে আছে।
কিন্তু রেগে থাকলেও গগন বন্দ্যোপাধ্যায় ধৈর্যশীল শান্ত মানুষ। ছেলেমেয়েদের গায়ে হাত তোলেন না। তবে গম্ভীর মানুষকে সকলেই ভয় পায়। তাঁর ছেলেমেয়েরাও তাঁকে যমের মতো ডরায়। গগনবাবু সারাদিন শরীরে রাগটা চেপে রাখলেন। রাত্রিবেলা খাওয়াদাওয়ার পর বড় ছেলেকে ডাকিয়ে আনলেন তাঁর ঘরে। তাঁর মনে হল, দুখিরামবাবুর প্রশ্নটার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম খোঁচা আছে, “আপনি কি এ-বিষয়ে নিশ্চিত যে, আপনার বড় ছেলে হরিবন্ধুর কোনও গুণই নেই?” আসলে গগনবাবু একজন ব্যস্ত ডাক্তার। নিজের ছেলেমেয়েদের দিকে মনোযোগ দেওয়ার মতো সময় তাঁর নেই। কাজেই কার কোন্ গুণ আছে সে বিষয়ে তাঁর ভাল ধারণা
-ও থাকতে পারে। দুখিরামবাবু তাই খোঁচাটা দিয়ে গেছেন। গগনবাবুর মনে হল, তাঁর বড় ছেলে হরিবন্ধুর বাস্তবিকই কোনও গুণ আছে কি না, তা তাঁর একটু খোঁজ করা উচিত।