এর পর কী করতে হবে, নবীনকে তা আর বলে দিতে হল। সে নির্দ্বিধায় সিঁড়ি বেয়ে সাবধানে নামতে লাগল। টর্চের আলোয় তলাটা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ইদারার গা বেয়ে নামতে নামতে নবীনের গায়ে ফের কাঁটা দিচ্ছিল। সে চাঁপাকুঞ্জের ফাঁপা অভ্যন্তরের সন্ধান পাবে কি?
সিঁড়ির শেষ ধাপটায় দাঁড়িয়ে পড়ে নবীন টর্চের আলোয় দেখতে পেল, পরের সিঁড়িটা যে সদ্য ভেঙে পড়েছে, তার সুস্পষ্ট দাগ রয়েছে ইদারার দেওয়ালে। দুই ভাই-বোন কি পড়ে গেছে ৮০
এখান থেকে? পড়ে গেলে বেঁচে আছে কি এখনও?
নবীন একটা মোটা লতা ধরে ঝুলে পড়ল নীচে। তারপর ধীরে-ধীরে নামতে লাগল।
লতা খুব জোরালো নয়। মাঝে-মাঝে হড়াস করে খসে যাচ্ছে। নবীন সঙ্গে-সঙ্গে অন্য লতা ধরে ফেলছে চট করে।
বেশিক্ষণ লাগল না। নবীন মাটিতে নেমে দাঁড়াল। তলাটা ভেজা-ভেজা, গোড়ালি অবধি ডুবে গেল নরম কাদায়।
নবীন টর্চ জ্বালতেই দেখতে পেল, অনু আর বিলু দুটো ডল-পুতুলের মতো পড়ে আছে মাটিতে। নবীন নাড়ি দেখল, নাকে হাত দিয়ে দেখল। চোট খুব বেশি লাগেনি বলেই মনে হচ্ছে। ভয় আর শক-এ অজ্ঞান হয়ে গেছে।
নবীন ধীরে-ধীরে দু’জনকে সোজা করে শুইয়ে দিল। তার পর নাক টিপে ধরল। চোখে ফুঁ দিল, এ সব অবস্থায় কী করতে হবে, তা জানা না থাকায় এবং কাছে হোমিওপ্যাথির ওষুধও নেই বলে সে দু’জনকে একটু কাতুকুতুও দিয়ে দেখল।
কয়েক মিনিট পরে প্রথমে চোখ মেলল অনু। “অনু, ভয় পেয়ো না। আমি নবীনদা।”
“নবীনদা, বিলু কোথায়?”
“এই তো! ভয় নেই, এখনই জ্ঞান ফিরবে। তোমার তেমন চোট লাগেনি তো?”
অনু একটু হাত-পা নাড়া দিয়ে বলল, “ডান হাতটায় ব্যথা লেগেছে। মাথাতেও। তবে তেমন কিছু নয়।”
একটু বাদেই বিলুও বড় করে শ্বাস ছেড়ে হঠাৎ কেঁদে উঠল, “দিদি! দিদি!”
অনু তার ভাইকে কোলে টেনে নিয়ে বলল, “এই তো আমি। তোর তেমন ব্যথা লাগেনি তো? এই দ্যাখ, নবীনদা এসেছে।”
বিলু কান্না থামিয়ে নবীনের দিকে চেয়ে বলল, “নবীনদা, তুমি কী করে বুঝলে যে, আমরা এখানে পড়ে গেছি?”
“সে অনেক কথা। কিন্তু আপাতত এখান থেকে বেরোবার উপায় করতে হবে।”
নবীন চার দিকে টর্চের আলো ফেলে দেখতে লাগল। ইদারার দেওয়ালে পুরু শ্যাওলা জমে আছে। স্তব্ধ হয়ে বসে আছে নানা আকারের শামুক। ফটফট করে ব্যাং ডাকছে। একটা কাঁকড়া বিছেকেও দেখা গেল টুক করে গর্তে ঢুকে যেতে। ইদারার মাঝখানটায় মেলা গাছপালা থাকায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। আর ইদারাটা তলার দিকে আরও অনেক বড়। প্রায় একটা হলঘরের মতো।
নীচে কাদা থাকায়, খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছিল তিনজনকে।
অনু বলল, “নবীনদা, এখান থেকে বেরোনোর তো আর উপায় নেই। লতা-পাতা বেয়েই উঠতে হবে..”
বিলু বলল, “আমার কনুইতে ভীষণ ব্যথা হচ্ছে। আমি লতা বেয়ে উঠতে পারব না।”
নবীন একটু হেসে বলল, “ঘাবড়িও না। এখান থেকে বেরোনোর কোনও একটা উপায় হবেই। কিন্তু আমি বারণ করা সত্ত্বেও তোমরা জঙ্গলে এসে ভাল কাজ করোনি। যে অবস্থায় পড়েছিলে, তাতে ভাল-মন্দ কিছু একটা হয়ে যেতে পারত।”
অনু একটু লজ্জিত হয়ে বলল, “আমরা ভেবেছিলাম, তুমি আমাদের ছেলেমানুষ ভেবে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ফেরত পাঠাচ্ছ।”
“তোমরা তো ছেলেমানুষই। যাকগে, যা হওয়ার হয়েছে। এখন দেখা যাক, আমাদের ভাগ্যটা কেমন।”
তারা ইদারাটার চারধারে বার-দুই চক্কর দিল। দেওয়ালে পুরু শ্যাওলার আস্তরণ ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়ল না।
নবীন দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “অঘোরবাবা বলেছিলেন, চাঁপাকুঞ্জের তলাটা ফাঁপা। যদি সেকথা সত্যি হয়ে থাকে, তবে একটা পথ পাওয়া যাবেই।”
লাঠিটা দিয়ে নবীন ইদারার গায়ে ঘা মারতে লাগল ফাঁপা শব্দ শোনার জন্য। কিন্তু পাথরের গায়ে তেমন কোনও শব্দ পাওয়া গেল না।
বিলু একটু উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। বলল, “ইশ, সত্যিই যদি একটা সুড়ঙ্গ পাওয়া যায়, তা হলে কী দারুণ ব্যাপার হবে!”
তিনজনেই কাদায় মাখামাখি হয়েছে। জুতোয় কাদা ঢুকে বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার। হাঁটাই শক্ত। বিলুর খিদে পেয়েছিল অনেক আগেই। এখন তেষ্টাও পেয়েছে।
হঠাৎ বিলুই চেঁচিয়ে বলল, “নবীনদা, দ্যাখো ওটা কী?”
টর্চের আলোয় একটা মস্ত ছুঁচোকে দেখে নবীন হেসে বলল, “ভয় পেয়ো না। ছুঁচো।”
বিলু বলল, “ভয় পাচ্ছি না। ছুঁচোটাকে ফলো করলেই বোঝা যাবে কোনও গর্ত আছে কি না।”
ছুঁচোটা ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে গা ঢাকা দিল। কিন্তু আরও দু’ একটাকে দেখা গেল, এদিক-ওদিক সরে যাচ্ছে।
বিলু চেঁচিয়ে উঠল, “নবীনদা! ওই যে! ওখানে একটা ছুঁচো ঢুকে গেল!”
নবীন জায়গাটা লক্ষ করে এগিয়ে গিয়ে আগাছা সরাতেই দেখতে পেল একটা গর্ত। গর্তটা বাস্তবিকই বেশ বড়। পাথরের জোড়ে একটা ফাটল। আগাছায় ঢেকে ছিল।
নবীন গর্তের মুখে লাঠিটা ঢুকিয়ে চাড় দিতে লাগল। ভয় হল, বেশি চাপ দিলে যদি লাঠি ভৈঙে যায়!
নবীনের কানে কানে কে যেন বলে উঠল, “লাঠি ভাঙবে না। লাঠিতে আমি ভর করে আছি।”
নবীন প্রাণপণে চাপ দিতে লাগল। আর খুব ধীরে-ধীরে পাথরটা সরতে লাগল। তার পর হঠাৎ খাঁজ থেকে খসে চৌকো পাথরটা ধপাস করে পড়ে গেল কাদার মধ্যে।
পাথরের পিছনে যে রন্ধ্র-পথটা উন্মোচিত হল, তা সঙ্কীর্ণ বটে, কিন্তু হামাগুড়ি দিয়ে ঢোকা যায়।