দু ভাই-বোনে কুয়োটার চার পাশ ঘুরে দেখল। “দিদি! এখন কী করবি?”
“আয়, ওপরে উঠব।”
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে তাদের বেশি কষ্ট হল না। কুয়োর ভিতরে এত আগাছা জন্মেছে যে, সেই সব গাছপালার ডগা ওপর পর্যন্ত উঠে এসেছে। নীচে অন্ধকার। গাছপালার ফাঁক দিয়ে খুব সরু সিঁড়ির ধাপ নীচে নেমে গেছে।
“এর মধ্যে নামতে চাষ দিদি? কিন্তু রেলিং নেই যে!”
“তাতে কী হল। ঠিক নামতে পারব। পড়ে গেলে ব্যথা লাগবে না, গাছপালায় আটকে যাব।”
অনু আগে, পিছনে বিলু। সাবধানে দুই ভাই-বোনে কুয়োর মধ্যে নামতে লাগল। ভারী মজার সিঁড়ি, কুয়োর চার পাশে ঘুরে-ঘুরে নেমে গেছে।
বিলুর প্রথমটায় পড়ে যাওয়ার ভয় হচ্ছিল। কারণ সিঁড়ির ধাপ এক ফুট চওড়া নয়, কিন্তু নামতে গিয়ে দেখল, দিদির কথাই ঠিক। গাছপালাগুলোই দিব্যি রেলিঙের মতো কাজ করছে।
নামতে-নামতে এক সময়ে বিলু ওপর দিকে তাকিয়ে দেখল। “দিদি!”
“কী রে?”
“ওপরটা যে দেখা যাচ্ছে না। আমরা কোথায় নামলাম?”
“ভয় নেই। ওপরটা গাছপালার আড়ালে পড়েছে।” এক সময়ে হঠাৎ থেমে গিয়ে অনু বলল, “বিলু! আর যে সিঁড়ি নেই।”
“তার মানে?”
“সিঁড়ি ভেঙে গেছে।”
“তা হলে?”
অনু একটু ভাবল। তার পর বলল, “গাছ বেয়ে নামতে পারবি? এখানে বেশ মোটা-মোটা লতাপাতা আছে।”
“তার চেয়ে ফিরে যাই চল।”
অনু একদম শেষ ধাপটায় দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ সে একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল, “মা গো!”
জরাজীর্ণ সিঁড়ির শেষ ধাপটা অনুর ভার সইতে না পেরে হঠাৎ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে গেল নীচে।
বিলু অন্ধকারে বিহ্বল হয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ বুক-ফাটা ডাক দিল, “দিদি?”
তলা থেকে কোনও জবাব এল না।
বিলু প্রথমটা ভীষণ ঘাবড়ে গেলেও বুঝতে পারল, এ-সময়ে ঠাণ্ডা মাথায় কাজ না করলে দিদিকে বাঁচানো যাবে না।
তার কাছে টর্চ নেই। সুতরাং নীচের দিকটা সে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। তার চার দিকেই ঘন অন্ধকার।
বিলু বার কয়েক ডাকল, “দিদি! এই দিদি! শুনতে পাচ্ছিস?”
কেউ জবাব দিল না।
বিলুর চোখ ফেটে কান্না এল। দিদিকে সে ভীষণ ভালবাসে। দিদির যদি কিছু হয়, তা হলে সে থাকবে কী করে?
বিলু হাত বুড়িয়ে খুঁজতে-খুঁজতে একটা মোটা লতা নাগালে পেয়ে গেল। খুব ধীরে ধীরে লতাটা ধরে সে নামতে লাগল নীচে।
কাজটা খুব সহজ হল না। লতাপাতায় এতই নিচ্ছিদ্র হয়ে আছে তলার দিকটা যে, তার হাত-পা ছড়ে যাচ্ছিল। মাঝে-মাঝে আটকে পড়ছিল সে। সে টারজান, অরণ্যদেব, টিনটিন এবং এই রকম সব বীরপুরুষদের কথা ভাবতে লাগল প্রাণপণে। এরা তাৈ কতই শক্ত কাজ করে, তাই না?
আচমকাই বিলুর ধরে থাকা লতাটা হড়াস করে আলগা হয়ে গেল।
অন্ধকারে কী থেকে যে কী হয়ে গেল! ঝোঁপঝাড়, লতাপাতা ভেদ করে বিলু পড়ে যেতে লাগল। একেবারে অসহায়ের মতো।
“বাবা গো!”
তারপর ঝপ করে কিছুর ওপর আছড়ে পড়ল সে। মাথাটা ঘুরে গেল। চোখ অন্ধকার হয়ে গেল তার।
৭. সদাশিববাবুর নাতি আর নাতনি
সদাশিববাবুর নাতি আর নাতনিকে বাড়িতে ফেরত পাঠিয়েও নবীন স্বস্তি পাচ্ছিল না। অনু আর বিলুকে সে খানিকটা চেনে। দুজনেই ভারী একগুঁয়ে আর জেদি। সদাশিববাবুরই তো নাতি আর নাতনি। তার ওপর ওদের শরীরেও ডাকাতের রক্ত আছে।
সুতরাং নবীন ফের সদাশিববাবুর বাড়ির দিকে ফিরল। কথাটা সদাশিববাবুকে জামানো দরকার।
সদাশিববাবুর মনটা বিশেষ ভাল নেই। সিদ্ধিনাথের মতো পুরনো আর বিশ্বাসী লোককে এভাবে ঘায়েল করল কে, তা-ই ভেবে তিনি ভীষণ উদ্বেগ বোধ করছেন। বাইরের ঘরে শাল মুড়ি দিয়ে বসে তিনি এই সবই ভাবছিলেন।
নবীনকে দেখে বললেন, “এসো হে নবীনচন্দ্র, কেটেরহাট যে আবার বেশ বিপদের জায়গা হয়ে উঠল।”
“তা-ই দেখছি।”
“ডাকাতের আমলে এখানে খুন-জখম হত বটে, কিন্তু সে তো অতীতের কথা। ইদানীং তো কেটেরহাটের মতো নিরাপদ জায়গা হয় না।”
“যে আজ্ঞে।”
“তা হলে এ সব হচ্ছেটা কী?”
“আমিও ভেবে পাচ্ছি না।”
“তার ওপর বাঘের ডাকও শোনা যাচ্ছে।”
নবীন একটা চেয়ারে বসে বলল, “ব্যাপারটা সবাইকেই ভাবিয়ে তুলেছে সদাশিববাবু। এমনকি, অনু আর বিলু অবধি জঙ্গলে যেতে চাইছে।”
সদাশিববাবু একটু চমকে উঠে বললেন, “জঙ্গলে? খবরদার না। কে ওদের এই বুদ্ধি দিয়েছে?”
“আপনি উত্তেজিত হবেন না। ছেলেমানুষ তো! ভারী অ্যাডভেঞ্চারের শখ। আমি ওদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠাণ্ডা করেছি। আপনিও একটু নজর রাখবেন, যেন হুট করে বেরিয়ে না পড়ে। বেরোলে বিপদ হতে কতক্ষণ?”
“বটেই তো! ওরে ও বচন, অনু আর বিলুকে ডাক তো। বল, এক্ষুনি আসতে।”
বচন এসে বলল, “ওনারা তো যাত্রা শুনতে গেছেন।“
“তাই তো! আমাকে তো বলেই গেছে।”
নবীন একটু অস্বস্তিতে পড়ে বলল, “না, যাত্রা শুনতে যাচ্ছিল বটে, কিন্তু আমি ওদের ফের ফিরিয়ে ফটক অবধি পৌঁছে দিয়ে গেছি। বচন, ভাল করে খুঁজে দ্যাখো তো?”
বচন গিয়ে একটু বাদে এসে বলল, “বাড়িতে নেই।”
সদাশিববাবু উত্তেজনায় উদ্বেগে খাড়া হয়ে উঠলেন, “বলিস কী? বাড়িতে নেই মানে?”
বুদ্ধিমান নবীন অবস্থাটা বুঝে চোখের পলকে সামলে নিল পরিস্থিতিটা। বলল, “আপনি উত্তেজিত হবেন না। যাত্রার লোভ আমি নিজেও সামলাতে পারি না। ও বড় সাঙ্ঘাতিক নেশা। আসলে হল কী জানেন, আমি ওদের যেতে বারণ করলেও ওরা মানতে চাইছিল না। আমার মনে হয়, ওরা ফের যাত্রাতেই গেছে। আমি গিয়ে দেখে আসছি।”