যতীনডাক্তার চিন্তিতভাবে বললেন, “শশীমুখী বউমা ঠিকই বলেছেন। ভূত-টুত দেখার একটা আলাদা অ্যাটমস্ফিয়ার আছে। দিনেদুপুরে বাজারে ভিড়ের মধ্যে ভূত দেখাটা তো ঠিক হচ্ছে না!”
নীলমণি ঘোষ বললেন, “ঘোর কলিকাল বলেই হচ্ছে। এর
পর বেলা বারোটায় আকাশে তারা দেখা গেলেও আশ্চর্যের কিছু নেই।”
অভয়পদ বলল, “এসবের মূলে কি গ্লোবাল ওয়ার্মিং আর এল নিনো আছে বলে আপনার মনে হয় ডাক্তারবাবু?”
শশীমুখী রোষ-কষায়িত লোচনে তার দিকে তাকাতেই অভয়পদ তাড়াতাড়ি পিছিয়ে ভিড়ের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল।
যতীনডাক্তার বিদায় হলেন। ঘরের ভিড়টাও ধীরে ধীরে পাতলা হয়ে গেল। একা হওয়ার পর বিজয়বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ খুললেন। আর চোখ খুলেই শুনতে পেলেন, ভিতর দিককার বারান্দায় নয়নতারা শশীমুখীকে বলছে, “ও বড়দি, ভূতই দেখুন আর যা-ই দেখুন, মেজদা কিন্তু বাজারটা করেছেন ভারী ভাল! কী সুন্দর কচি লাউ এনেছেন দেখুন! আর বাজারের সেরা ফুলকপি, সরু ডাঁটিওয়ালা। কী ভাল বড়-বড় টম্যাটো, কচি পালং, নারকুলে বাঁধাকপি আর কড়াইশুটি!”
বাসবীও বেশ উঁচু গলায় বলল, “আর মাছটাও একদম এক নম্বর। এমন পাকা তেলালো রুই অনেকদিন আসেনি। নাঃ, মেজদার মতো এত সুন্দর বাজার কাউকে করতে দেখিনি!”
প্রশংসা শুনে বিজয়বাবুর মুখ শুকোল! সর্বনাশ! তাঁর বাজারের সুখ্যাতি বেশি ছড়ালে যে এবার থেকে তাঁকেই ঠেলেঠুলে রোজ বাজারে পাঠানো হবে। সেই ধকল কি তিনি সইতে পারবেন? হার্টফেল হয়ে যাবে যে!
খুব সরু গলায় পাশ থেকে কে যেন বলে উঠল, “বাবু!”
বিজয়বাবুর বুকের ভিতরে হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠে পাঁজরে জোর একটা ধাক্কা দিল। তিনি টক করে চোখ বুজে ফেলে ককিয়ে উঠলেন, “ভূ-ভূত! না না, আমি আর ভূত দেখতে পারব না বাবা। আর নয়। একদিনের পক্ষে যথেষ্ট হয়েছে। তুমি বরং আর একদিন…!” ৭০
“বাবু, আমি লখাই!” বিজয়বাবু মিটমিট করে তাকিয়ে দেখলেন, লখাই-ই বটে। তাঁর বিছানার পাশে মেঝেয় বসে দাঁত বের করে হাসছে।
“হাসছিস যে বড়?”
“ভয় খেলেন তো, তাই দেখেই হাসছি।”
“মানুষ ভয় খেয়ে মরতে বসলে কি তোর মজা হয়?”
“না বাবু, বলছি, তেনারা তো আপনার ভালই করতে চেয়েছিলেন?”
বিজয়বাবু খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “তা ভালটা একটু আড়াল আবডাল থেকে করা যেত না? অমন বুক ফুলিয়ে চোখের সামনে এসে ভাল করতে হয়? তাতে যে হার্টফেল হতে পারে, সেটাও তো ভাল করার আগে ভাবা উচিত ছিল।”
লখাই মাথা-টাথা চুলকে বলল, “তা বটে! তবে কিনা তেনাদের মতিগতি বোঝা ভারী শক্ত। কিন্তু আপনার সঙ্গে তেনাদের যে একটা ভারী কাজের কথা আছে! না বললেই নয়।”
বিজয়পদ অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়ে বললেন, “ওরে না না! আমি কোনও কথাটথা শুনতে পারব না! আর দেখা-সাক্ষাতেরও দরকার নেই।”
“কিন্তু বাবু, কথাটা যে বড্ড কাজের ছিল।”
“কী কথা? অ্যাঁ? আমার সঙ্গে তাদের এত কথা কীসের?”
লখাই ফের মাথাটাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে, আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, কী আর বলব? তবে যতদূর জানি, একটা বই নিয়ে কথা। বইখানা নাকি খুব কাজের বই।”
“বই!” বলে হঠাৎ বিজয়পদ শোওয়া অবস্থা থেকে সটান হয়ে বসে বললেন, “তাই তো! সর্বেশ্বর পণ্ডিত তো একটা বইয়ের কথাই বলেছিলেন! হিব্রু ভাষায় ছাপা বাইবেল!”
লখাই একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে, সেইখানাই!”
“তার মধ্যে নাকি গুপ্তধনের হদিশ আছে?”
বিজয়পদ তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বললেন, “চল তো দেখি।”
লাইব্রেরি ঘরে এসে বিজয়পদ কাঠের মইখানা উত্তর দিকের দেওয়ালে একেবারে কোণ ঘেঁষে দাঁড় করালেন। কোথায় কোন বই রাখা আছে এটা তাঁর একেবারে মুখস্থ। চোখ বেঁধে দিলেও বের করতে পারবেন।
লখাই মইখানা চেপে ধরে রইল। বিজয়পদ খুব সাবধানে মই বেয়ে উপরে উঠলেন। বাঁ ধারে পরপর দশ-বারোখানা নানা সংস্করণের বাইবেল সাজানো। বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়খানাই হিব্রু ভাষার বাইবেল। কিন্তু জায়গাটা ফাঁকা!
বিজয়পদ একটা আর্তনাদ করলেন, “সর্বনাশ!”
“কী হল বাবু?”
“বইটা তো নেই!”
“বলেন কী বাবু? এঃ হেঃ, তেনারা যে ভারী নেতিয়ে পড়বেন?”
স্তম্ভিত বিজয়পদ মই থেকে নামার কথা অবধি ভুলে গিয়ে দু’ হাত মাথায় দিয়ে ডুকরে উঠতে যাচ্ছিলেন। সাধারণত মইয়ের উপর উঠলে দু হাত ছেড়ে দেওয়ার নিয়ম নেই, তা যুক্তিযুক্তও নয়, বুদ্ধিমত্তার পরিচয়ও নয়। সুতরাং বিজয়বাবু মইয়ের ডগা থেকে চিতপটাং হয়ে সোজা মেঝের উপর পড়তে লাগলেন। তবে একেবারে শেষ মুহূর্তে দুটো জোরালো হাত তাঁকে ধরে পাঁজাকোলে তুলে না নিলে বিপদ ছিল।
পড়ার ধকলে বিজয়পদর মাথাটা ডোম্বল হয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। তারপর আবছা চোখে খোঁচা-খোঁচা দাড়িওয়ালা মুখটা দেখে ককিয়ে উঠলেন, “ভূ-ভূত! ভূ-ভূত!”
লোকটা তাঁকে যত্ন করে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল, “আজ্ঞে, ভূতও বলতে পারেন। আমি কি আর মনিষ্যির মধ্যে পড়ি? তবে কিনা এখনও চৌকাঠটা ডিঙনো হয়নি, এই যা!”
“ও, আপনি সেই বটু সর্দার, তাই না?”
“যে আজ্ঞে। তা বাবু, অমন হন্তদন্ত হয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে কোন বইটা খুঁজছিলেন বলুন তো?”
বিজয়পদ একটু ধাতস্থ হয়েছেন। সুতরাং সতর্কতা অবলম্বন করে বললেন, “ও একটা ইংরেজি বই।”
লোকটা ঘরের কোণ থেকে চামড়ায় বাঁধানো একটা মোটা বই কুড়িয়ে নিয়ে এসে বলল, “আজ্ঞে, আমি মুখ মানুষ। ইংরেজিও জানি না, হিব্রুও জানি না। তা দেখুন তো, এই বইটা নাকি?”