জানলাটা নিঃশব্দে একটু ফাঁক হল। ফাঁকে খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা একটা মুখ।
“পানু আর নিতাই আপনাকে খুঁজছে।”
“হু।”
“জনসাহেবের কবরেরও খোঁজ হচ্ছে।” বটু সর্দার নির্বিকার গলায় বলল, “সেরকমই তো হওয়ার কথা, হলেই আশ্চর্যির ব্যাপার ছিল। এইটুকু থেকে শিখিয়ে-পড়িয়ে লায়েক করে দিলুম, সে কি আর আহাম্মকি করতে পারে? করলে ভাবতুম, আমার শিক্ষেটাই বৃথা গিয়েছে।”
“কে? কার কথা বলছেন বলুন তো!” বটু মিটমিট করে চেয়ে বলল, “নিতাইয়ের কথাই তো হচ্ছে।”
“তা সে যদি আপনারই চেলা, তা হলে আর ভাবনা কী? আমি তো ভাবলুম, সে অন্য কোনও মতলবে আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।”
“তা তো খুঁজছেই। তার ভয়েই তো গা ঢাকা দিয়ে আছি।”
“তবে যে বললেন, এইটুকু বয়স থেকে শিখিয়ে পড়িয়ে লায়েক করেছেন?”
“তা তো করেছিই। ফুটবল খেলা দেখিসনি?”
“তা দেখব না কেন?”
“ধর, দুটো ভাই দু দলে খেলছে। তা ভাই বলে কি একজন আর-একজনকে ছেড়ে কথা কইবে? নিতাইয়ের সঙ্গে এখন আমার সেই সম্পর্ক।”
“তা আপনাকে পেলে নিতাই কী করতে চায়?”
“সে আর শুনতে চাসনি। রাতের ঘুম নষ্ট হবে। বাড়ি যা।”
“আর-একটা কথা শুনেই চলে যাব। নিতাইকে পেলে আপনি কী করবেন?”
বটু মিটমিট করে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে মাথা নেড়ে বলল, “আমার কিছু করার নেই।”
“তবে কি মরবেন?”
বটু নির্বিকার গলায় বলল, “আমাকে না মেরে নিতাইয়ের উপায় নেই কিনা।”
“আপনি খুব গোলমেলে লোক।”
“কেন বল তো?”
“নিতাই আপনাকে মারতে চায় জেনেও কেন যেন হেলদোল নেই আপনার।”
বটু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “বিকিকিনি শেষ হলে দোকানদাররা দোকানের ঝাঁপ ফেলে দেয়! তাই না?”
“তা তো দেয়ই। আপনারও কি ঝাঁপ ফেলার সময় হয়েছে?”
এবার একটু হাসল বটু। তারপর বলল, “ঠিক ধরেছিস। অনেক চোর-ছ্যাঁচোড় তৈরি করেছি, পাপটাপও বড় কম জমেনি, বুঝলি!”
“আর-একটা কথা, জনসাহেবের কবর নিয়ে কথা উঠছে কেন?”
“উঠছে নাকি? তা উঠলে আমি কী করব?”
“তার মানে আপনি বলবেন না?”
“সব গুহ্যকথা জেনে তোর হবেটা কী? যত জানবি তো বিপদ। বিপদ-আপদকে কি ডেকে এনে পিঁড়ি পেতে বসাতে আছে?”
“জনসাহেবের কবরের কথা আমিই নিতাই আর পানুকে বলেছি। কাজটা ভুল হল কি না বুঝতে পারছি না।” নির্বিকার গলাতেই বটু বলল, “তুই না বললেও আর কেউ বলত। তুই কিছু ভুল করিসনি।”
৪. বিজয়বাবু হাঁ হয়ে গেলেন
“বাজার!” বলে একটা আর্তনাদ করে বিজয়বাবু হাঁ হয়ে গেলেন।
গুরুপদ দুখানা ভাঁজ করা বাজারের ব্যাগ বিজয়বাবুর শিথিল হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ মেজদা, বাজার।”
বিজয়বাবু হঠাৎ সোজা হয়ে বসে অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে বললেন, “আমি করব বাজার? আমাকে বাজারে যেতে বলিস, তোর এত সাহস?”
গুরুপদ সভয়ে দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, “আহা, আমি তোমাকে বাজার করতে বলব কেন?”
“এই যে বললি? জীবনে কখনও বাজারে গেলুম না, আর এখন তুই আমাকে বাজারে যাওয়ার হুকুম করিস?”
“আমি বলছি না তো! আমি বলতে যাব কোন দুঃখে? এ আমার বলা নয়, আমাকে দিয়ে বলানো হয়েছে মাত্র।”
“কে? কার এত সাহস?”
“বড়বউদি আর মেজোবউদি।”
বিজয়পদ চোপসানো বেলুনের মতো হয়ে গিয়ে ফাসফেসে গলায় বললেন, “তা সেটা আগে বলতে হয়। কিন্তু আমাকে তারা বাজারে পাঠাতে চায় কেন জানিস?”
“কাল রাতে বাড়িতে বউদিরা মিলে মিটিং করেছে। তাদের মত হল, তোমার কোনও এক্সারসাইজ হচ্ছে না, তুমি দিনদিন অলস আর ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছ। গ্রন্থকীট হওয়ার ফলে তোমার বস্তুজ্ঞান লোপ পাচ্ছে এবং তুমি আজকাল প্রায়ই ভূত দেখছ। ফলে আজ থেকে তোমার রুটিন পালটে ফেলতে হবে। বাইরের খোলা হাওয়া বাতাসে ঘুরে বেড়াতে হবে, বাজার-হাট করতে হবে, লোকের সঙ্গে মেলামেশা বাড়িয়ে দিতে হবে।”
বিজয়বাবু কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে বললেন, “লিস্টিতে আর কিছু নেই? এভারেস্টে ওঠা বা ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়া!”
“পরে হয়তো সেসব নিদানও দেওয়া হবে। আজ বাজার দিয়ে শুরু।”
বিজয়বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে করুণ গলায় বললেন, “বাজারটা কোন দিকে যেন?”
“পুব দিকে।”
“অ। তা সে না হয় হল! কিন্তু হা রে, বাজার কীভাবে করতে হয় জানিস?”
“তা জানব না কেন?”
“তা হলে তুইও না হয় সঙ্গে চল।”
“আমার ঘাড়ে একটা বই দুটো মাথা তো নেই মেজদা।”
“তা বটে।”
গুরুপদ অভয় দিয়ে বলল, “ভয়ের কিছু নেই, ফর্দ ধরে বাজার করলেই হবে। লাউ, কুমড়ড়া, পালংশাক, ধনেপাতা, বেগুন, উচ্ছে, নিমপাতা, আলু, টম্যাটো, পোনামাছ আর হাঁসের ডিম।”
“ওরে বাবা! এত খাওয়া কি ভাল?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিজয়বাবুকে উঠতে হল। তিনি কখনও যুদ্ধে যাননি বটে, কিন্তু আজ মনে হয়, সেটাও এমন কিছু নয়। বাজারে চোর, জোচ্চোর, পকেটমার ঘুরে বেড়ায়, দর বেশি হাঁকে, ওজনে ফাঁকি দেয়, পচা জিনিস গছিয়ে দেয়। কী করে সব দিক সামলাবেন সেই দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে দুরুদুরু বক্ষে তিনি বাজারে রওনা হয়ে পড়লেন।
বাড়ির কাছেই মোড়ের মাথায় ভবেন রক্ষিতের সঙ্গে দেখা। “কে রে, বিজয় নাকি? বাজারে যাচ্ছিস?”
“হ্যাঁ ভবেনা।”
“ভাল-ভাল। আমিও একটু আগেই বাজার ঘুরে এলুম কিনা! তা আজ নন্দগোপালের কাছে ভাল বেগুন পাবি। একেবারে কাশীর বেগুনের মতো স্বাদ। ধনঞ্জয় টাটকা লাউ পেড়ে এনেছে। সুকুমারের দোকানে আলতাপাটি শিম এসেছে দেখেছি।”