জরিবাবু কী বলবেন তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তবে দুর্বল গলায় একবার ডাকলেন, “ওরে ন্যাড়া, এদিকে আয়।”
“ন্যাড়া! ন্যাড়ার অবস্থা আপনার চেয়েও খারাপ। একটু আগে দেখে এসেছি শয্যা নিয়েছেন।”
০৬-১০. জরিবাবু ক্ষীণ গলায় বললেন
জরিবাবু ক্ষীণ গলায় বললেন, “তাহলে উপায়?”
“কিসের উপায় খুঁজছেন খোলসা করে বলে ফেলুন, উপায় বাতলে দেব। পঞ্চানন্দ থাকতে উপায়ের অভাব কী? আপনার বাবাকেও কত উপায় বাতলে। দিয়েছি। পাগল-ছাগল মানুষ, কখন কী করে বসেন তার ঠিক নেই। মাঝে মাঝে বিপাকে পড়ে যেতেন খুব। একবার তো কী একটা ওষুধ বানিয়ে খেয়ে বসেছিলেন। আমি তাঁর জাদুইঘরের বারান্দায় শুয়ে আছি। নিশুত রাত্রি। হঠাৎ ‘হাউরে মাউরে চেঁচানি শুনে কঁচা ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসেছি। তারপর দৃশ্য দেখে চোখ চড়কগাছ। কী দেখলাম জানেন? সামনে ধুতি পাঞ্জাবি পরা একটা লোক।”
জরিবাবু হাঁ করে শুনছিলেন, এবার নিশ্চিন্তে শ্বাস ফেলে বললেন, “লোক! যাক বাবা, আমি ভাবলাম বুঝি……”
পঞ্চানন্দ মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু, অত নিশ্চিত হবেন না। তোক বলেছি বলেই কি আর লোক। এমন লোক কখনও দেখেছেন যার মুণ্ডু নেই, হাত নেই, পা নেই, চোখ চুল নখ কিছু নেই,তবু লোকটা আছে?”
“আজ্ঞে না।”
“মাঝরাতে আমি উঠে যাকে দেখলাম তারও ওই অবস্থা। তার গলার স্বর শুনছি, ধুতি-পাঞ্জাবি দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু লোকটা গায়েব। কিছুক্ষণ, মশাই, আমার হাতে পায়ে সাড় ছিল না। তারপর গলার স্বর শুনে আর পাঞ্জাবির বুকপকেটের ভেঁড়াটা দেখে বুঝতে পারলাম যে, অদৃশ্য লোকটা আসলে শিবুবাবু, আপনার স্বর্গত পিতামশাই।”
“বলেন কী?”
“যা বলছি স্রেফ শুনে যান। বিশ্বাস না করলেও চলবে। তবে কিনা ঘটনাটা নির্জলা সত্যি। শিবুবাবু তো আমার হাত জাপটে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “ওরে পঞ্চু, তুই না বাঁচালে আর আমার রক্ষে নেই। সলিউশন এ এন ফর্টি খেয়ে এই দ্যাখ আমার অবস্থা। স্রেফ গায়েব হয়ে গেছি। আয়নায় ছায়া পড়ছে, নিজেকে হারিয়েও ফেলেছি। একটু খুঁজে দে বাবা। ওরে, আমি আছি তো!”
“বটে!”
“তবে আর বলছি কী? আমি ঠাহর করে করে বাবুর মাথাটা খুঁজে হাত বুলিয়ে বললাম, “অত চেঁচামেচি করবেন না। লোক জড়ো হয়ে যাবে। ঠাণ্ডা হয়ে বসুন, আমার মাথায় ফন্দি এসে গেছে। তারপর কী করলাম জানেন?”
“কী করলেন?”
“বলছি, তার আগে বেশ ভাল করে একটা পান খাওয়ান দেখি। কালোয়াতরা শুনেছি গলা সজুত রাখতে পান আর জর্দা খায়। তা আপনার বেশ ভালো জর্দা আছে তো?”
জরিবাবু এবার খানিকটা স্বাভাবিক গলায় বললেন, “আছে।”
“লাগান একখানা জম্পেশ করে।”
জরিবাবুর হাত এখনও কাঁপছে। তবু পেতলের বাটা থেকে এক খিলি সাজা। পান আর জর্দা পঞ্চানন্দকে দিয়ে নিজেও এক খিলি খেলেন। বললেন, “তারপর?”
পঞ্চানন্দ জারিবাবুর পিতলের পিকদানিতে পিক ফেলে কিছুক্ষণ আরামে চোখ বুজে পানটা চিবিয়ে নিমীলিত চোখে বলল, “ফন্দিটা এমন কিছু নয়। ওর চেয়ে ঢের বেশি বুদ্ধি আমাকে খেলাতে হয়। করলাম কি, সেই রাতের মতো শিববাবুকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে পরদিন সকালেই বাজারে গিয়ে খানিকটা তেলরং কিনে আনালাম। তারপর শিবুবাবুর হাতে-পায়ে মুখে খুব যত্ন করে রং লাগাতেই ফের আসল মানুষটা ফুটে উঠল। বলতে নেই, আপনার বাবামশাই বেশ কালোই ছিলেন। আমি এক পোচ ফর্সা করে দিলাম। একটা মুশকিল হল, চোখে তো আর রং লাগাতে পারি না। তাই একজোড়া পরকলা পরিয়ে দিতে হল। দিব্যি দেখাত। তাই বলছিলাম, পঞ্চানন্দ থাকতে উপায়ের অভাব?”
জরিবাবু হাঁ করে শুনতে শুনতে জর্দাসুদ্ধ পিক গিলে ফেলে হেঁচকি তুলতে তুলতে বললেন, “বাবাকে রং করলেন?”
“তবে আর বলছি কী? কেন, টেন পাননি আপনারা? শিবুবাবুর গায়ের রংটা ছিল আদতে তেলরং।”
“আর কখনও ওরিজিন্যাল চামড়া ফুটে ওঠেনি?”
“তাই ওঠে? সলিউশন এ এম ফর্টি বড় সাঙ্ঘাতিক জিনিস। তবে উপকারও হত। একবার রহিম শেখ পড়ল একটা মিথ্যে খুনের মামলায়। লোকটা ভাল, সাতচড়ে রা নেই। তবু কপাল খারাপ। এসে শিবুবাবুর হাত জাপটে ধরল;, শিবু, বাঁচাও। তখন শিবুবাবুর অগতির গতি ছিলাম আমি। উনি এসে আমাকে বললেন, “রহিম আমার ছেলেবেলার বন্ধু রে পঞ্চু, একটা উপায় কর। আমি তখন দিলাম সলিউশন এ এম ফর্টি এক চামচ ঠেসে। রহিম শেখ গায়েব হয়ে গেল। দিব্যি খায় দায়, ফুর্তি করে বেড়ায়, পুলিশের নাকের ডগা দিয়েই ঘোরে, পুলিশ রহিম শেখকে খুঁজে খুঁজে ওদিকে নাচার হয়ে পড়ে। সে ভারি মজার ঘটনা। তা এ-রকম আরও কিছু-কিছু লোককে আমরা গায়েব করে দিয়েছিলাম বটে। তাদের মধ্যে কেউ-কেউ এখনও আছে। কখনও অশরীরী গলার আওয়াজ পান না?”
হরিবাবু আঁতকে উঠলেন। তারপর চারপাশটা সন্ধিগ্ধ চোখে একটু দেখে নিয়ে বললেন, “ঠিক মনে পড়ছে না।”
“একটু চেপে মনে করার চেষ্টা করুন। এখনও দু’চারজন ঘোরাফেরা করে। একটু আগে আপনার ঘরে ঢোকার মুখেই কার সঙ্গে যেন একটা ধাক্কা লাগল। ব্যাটাকে ধরতে পারলাম না। আমাকে দেখেই পালিয়ে গেল। তবে আছে তারা।
“ওরে বাবা! ধাক্কাও দেয়?”
পঞ্চানন্দ খুব হাসল। পানের পিক ফেলে বলল,”ধাক্কা তো ভাল জিনিস। ইচ্ছে করলে কত কী করতে পারে। আপনাকে পছন্দ হল না তো গলাটাই রাত্তিরে নামিয়ে দিয়ে গেল, কি তানপুরার তারগুলো ছিঁড়ে তা ফাঁসিয়ে রেখে গেল। কেউ তো আর তাদের ধরতে পারছে না।”