লোকটা ঠ্যাং দোলাতে দোলাতে উদাস গলায় বলল, “সত্যি কথা বললেই আজকাল লোকে চটে যায় দেখছি। তা আমি কী করব বলুন, নিজের চোখে যা দেখেছি তা অস্বীকার করি কী করে?”
“তার মানে তুমি রোজই এ-বাগানে হানা দাও!”
“তা দিই। গত বাইশ দিন ধরেই দিচ্ছি।”
অঘোরকৃষ্ণের চোখ কপালে উঠল, “অ্যাঁ! বাইশ দিন! তুমি তো ডাকাত হে! বলি তোমার মতলবখানা কী?”
লোকটা ঘাড় চুলকে বলে, “মতলব কিছু খারাপ ছিল না মশাই। গা ঢাকা দিয়ে কী করে বাড়ির মধ্যে ঢোকা যায় তার সুলুকসন্ধান করছিলুম।”
“বলো কী? দিনে-দুপুরে গা-ঢাকা দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে চাও? সে কথা আবার বুক ফুলিয়ে বলছ?”
লোকটা বিমর্ষ গলায় বলে, “কী করব মশাই, রাতে যে আমার সুবিধে হয় না। তখন বড্ড ঘুম পায়।”
“এঃ, নবাবপুত্তুর! রাতে ঘুম পায়! চোর-ছ্যাঁচড়দের আবার রাতে ঘুম কিসের? অত আয়েসি হলে কি ও লাইনে চলে?”
লোকটা শুকনো মুখে বলে, “সেইজন্যই তো জীবনে উন্নতি হল মশাই! যে তিমিরে ছিলুম সেই তিমিরেই পড়ে আছি।”
খুবই বিরক্ত হয়ে অঘোরকৃষ্ণ বললেন, “অপদার্থ! অপদার্থ। সাধনা নেই, অধ্যবসায় নেই, কাজে নেমে পড়েছেন! আর কাজের ছিরিই বা কী! দিনে-দুপুরে প্রকাশ্য দিবালোকে দেয়ালের ওপর উঠে বসে পাঁচজনের কাছে নিজেকে জাহির করছেন। আচ্ছা, লজ্জা সরম বলেও তো একটা ব্যাপার আছে রে বাপু। এত আনাড়ি হলে কি চলে?”
লোকটা দুঃখিত মুখে তাঁর সঙ্গে একমত হয়ে বলল, “আজ্ঞে অতি নির্জলা সত্যি কথা। কায়দাকানুন আমার বিশেষ জানা নেই। তা মশাই, আপনি যদি একটু সুবিধে করে দেন, তা হলে আমার বড় উপকার হয়।”
অঘোরকৃষ্ণ অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে বললেন, “কীসের সুবিধে হে? তোমার হয়ে কি চুরি-ডাকাতি করে দিতে হবে নাকি?”
লোকটা একগাল হেসে ভারী লজ্জার সঙ্গে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলে, “অনেকটা সেরকমই আর কি।”
অঘোরকৃষ্ণ সমবেদনার সঙ্গেই বললেন, “বাপু হে, তুমি যখন কোনও কাজের নও তা হলে এ লাইনে এলে কেন?”
“পেটের দায়েই আসা মশাই। অন্য লাইনে সুবিধে হচ্ছিল না কি না।”
“তা আগে কী করতে?”
“সে শুনলে আপনি হাসবেন। ছিলুম বাজিকর। এই একটু-আধটু ম্যাজিক ট্যাজিক দেখাতুম।”
“বটে! ম্যাজিশিয়ান?”
“অনেকটা সেরকমই।”
“তা সেটা খারাপ কাজ হবে কেন? চুরির চাইতে তো ভাল।”
“পেট চালাতে পারলে খারাপ নয় বটে, তবে ওতেও বিশেষ সুবিধে হয়নি।”
“নাঃ, তুমি দেখছি কোনও কম্মের নও! ভেবেছিলুম তোমাকে চোর বলে ধরে নিয়ে গিয়ে বাবার কাছে একটু বাহবা আদায় করব। এখন দেখছি তোমার মতো অপদার্থকে ধরে নিয়ে গেলে বাবা হেসেই খুন হবে।”
লোকটা জুলজুল করে অঘোরকৃষ্ণের দিকে চেয়ে বলল, “তা এখন আমাকে অনেকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বটে, কিন্তু মশাই, একসময়ে আমারও একটু নামডাক হয়েছিল।”
“তাই নাকি? তা তোমার নামটা কী?”
“আজ্ঞে, জাদুকর গজানন।”
অঘোরকৃষ্ণের মুখে হাসি হাসি ভাবটা মিলিয়ে গেল। বড়বড় চোখ করে চেয়ে বললেন, “কী–কী বললে যেন!”
“আজ্ঞে, জাদুকর গজানন।”
“গ-গ-গ…”
বলতে বলতে অঘোরকৃষ্ণ হঠাৎ চোখ উলটে মূৰ্ছিত হয়ে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলেন।
ওদিকে হরিকৃষ্ণ খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ফের চারদিকে দুমদুম করে ঢিল ছুড়ছেন আর বিজয়গর্বে হাসছেন। এমন সময় হঠাৎ বাগানের একটা দুর্ভেদ্য কোণ থেকে একটা ঢিল উড়ে এসে ঠং করে জলের ট্যাঙ্কে লেগে ছিটকে এসে তাঁর মাথায় পড়ল। তিনি বাপ রে’ বলে চেঁচিয়ে দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বসে পড়লেন। ভাবলেন মাথাটা বোধ হয় দু’ফাঁক হয়ে গেছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে বুঝলেন তাঁর আঘাত তেমন গুরুতর নয়, আর ঢিলটাও ছোট। তখন তিনি রাগে লাফিয়ে উঠে রেলিঙের কাছে ছুটে গিয়ে চেঁচাতে লাগলেন, “কে রে? কার এত সাহস? এমন বুকের পাটা কার?”
কেউ অবশ্য জবাব দিল না।
হরিকৃষ্ণ রাগে গরগর করতে করতে দোতলায় নেমে আলমারি থেকে বন্দুক বের করে বাগানে ছুটে গেলেন।
যেদিক থেকে ঢিলটা এসেছিল সেদিকটায় ঝোঁপঝাড় একটু বেশি। বন্দুক বগলে নিয়ে পাকা শিকারির মতো এগিয়ে যাচ্ছিলেন হরিকৃষ্ণ। হঠাৎ দেখতে পেরেন, পাঁচিলের কাছ বরাবর তাঁর বড় ছেলে অঘোরকৃষ্ণ দিব্যি হাত পা ছড়িয়ে ঘাসজমির ওপর চিতপাত হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে।
হরিকৃষ্ণ কাছে গিয়ে ছেলের পেটে বন্দুকের নলের একটা খোঁচা দিয়ে অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, “তোমাকে না কতদিন দুপুরে ঘুমোতে বারণ করেছি! দুপুরে ঘুমোলে মানুষ অলস, বোকা আর অকর্মণ্য হয়ে পড়ে। আমার ভয়ে এখন ঘরে না ঘুমিয়ে লুকিয়ে বাগানে এসে ঘুমোতে শুরু করেছ! ছিঃ ছিঃ অঘোর, শেষমেশ এইরকম কপটতার আশ্রয় নেবে, এটা আমি ভাবিনি!”
অঘোরকৃষ্ণের ঘুম ভাঙার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। হরিকৃষ্ণ আরও কিছুক্ষণ তাঁর উদ্দেশ্যে ভর্ৎসনামিশ্রিত একখানা ভাষণ দিলেন এবং তারপর বুঝতে পারলেন পরিস্থিতি কিছুটা গম্ভীর। বুঝতে পারলেন অঘোরকৃষ্ণ ঘুমোচ্ছেন না, অজ্ঞান হয়ে গেছেন। তাঁর ভয় হল, একটু আগে তিনি যে দুর্দান্ত ঢিলগুলো মারছিলেন, তারই কোনওটা লেগে অঘোরকৃষ্ণের এই দশা হয়েছে কি না। কিন্তু তেমন কোনও ক্ষতচিহ্ন দেখা যাচ্ছিল না।
হরিকৃষ্ণ তাড়াতাড়ি বাগানে জল দেওয়ার লম্বা রবারের পাইপটা টেনে এনে অঘোরকৃষ্ণের মুখে চোখে জলের ছিটে দিলেন।