“খুব বুঝেছি।”
“তাতে সুবিধে বেশি। তাই না?”
“আমিও সেই কথাই বলি।”
“কোন কথা?”
‘ডানার চেয়ে দেশলাই ঢের ভাল। ঝামেলা কম।”
“হ্যাঁ। কথাটা মাথায় রেখে কাজ করো।”
“যে আজ্ঞে।”
রামলাল চলে যাওয়ার পর চঞ্চলমতি ভুবন রায় স্থির থাকতে পারলেন না। নানারকম জিনিসপত্র নিয়ে উড়ান-যন্ত্র তৈরি করতে বসে গেলেন। কাজে সাঙ্ঘাতিক মগ্ন।
ঘণ্টা-দুয়েক বাদে তিনি একটা বাক্সের মতো জিনিস বানিয়েও ফেললেন। ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আপনমনেই বললেন, “এটা দিয়ে কি সত্যিই ওড়া যাবে?”
কে যেন কানের কাছে বলে উঠল, “যাবে।”
“কে?”
“আজ্ঞে আমি দৈববাণী।”
দৈববাণী? বিজ্ঞানে কি দৈববাণীর কোনও স্থান আছে? ভুবন রায় ভ্রূ কুঁচকে ভাবলেন, তারপর তাঁর মনে হল, না হবেই বা কেন? ঈশ্বর তাঁকে অনন্ত ক্ষমতা দিয়ে পাঠিয়েছেন। তাঁর ভিতর দয়েই হয়তো ঈশ্বরের কোনও ইচ্ছা পূর্ণ হবে।
তিনি গলাখাঁকারি দিয়ে একটু ইতস্তত করে বললেন, “তা হ্যাঁ হে দৈববাণী, তুমি এখনও ধারেকাছে আছ নাকি?”
“বিলক্ষণ।”
“তা ইয়ে ভগবানের কাছে গিয়ে ব্যাপারটা তা হলে বোলো।” তা তো বলবই। ভগবানও জানেন কিনা, তিনিই পাঠালেন।”
ভুবন রায় দু’হাতআনন্দের সঙ্গে ঘষে নিয়ে বললেন, “বাঃ, চমৎকার। এতদিনে তা হলে নোবেলটাও পাওয়া যাবে, তা হ্যাঁ দৈববাণী, একটা কথা বলবে?”
“নিশ্চয়।” তা ওখানে আইনস্টাইন বা নিউটনের সঙ্গে দেখা হয়? “রোজ দু’বেলা হচ্ছে মশাই।”
“তা তাঁরা সব আমাকে নিয়ে আলোচনা করেন নাকি?”
“খুব করেন। রীতিমত ভাবনায় পড়েছেন সবাই।”
“কীরকম?”
“আপনি যা কাণ্ড করছেন, তাতে তো তাঁদের নাম দুনিয়া থেকে মুছে যাওয়ার দাখিল হয়েছে। কারও আর চোখে ঘুম নেই, খাওয়া কমে গেছে।”
“বটে!”
“তবে হ্যাঁ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, আর জগদীশচন্দ্র বসু খুব খুশি। আপনি বাঙালি হয়ে যেভাবে সাহেবদের টেক্কা দিলেন তার তুলনাই হয় না।”
“হেঃ হেঃ, এ আর এমন কী, সাহেবরাও এতদিন কম কিছু করেনি।”
“তা করলেও আপনার কাজে লাগে না।”
“তা বটে, আমার ধাতটা একটু অন্যরকম কিনা। এই তো রামলাল আমাকে অঙ্ক দিয়ে ভয় দেখাচ্ছিল, দিয়েছি ধমকে।”
“রামোঃ, অঙ্ক আবার একটা জিনিস নাকি?”
“আমার তো অঙ্কের দরকারই হল না। কেমন ওড়ার যন্ত্র বানিয়ে ফেললুম।”
“সেকথাই তো আমরা স্বর্গে আলাপ-আলোচনা করি।”
“বটে! বটে! তা কী কথা হয়?
“ভগবান নিজেই আপনার কথা তুলে মাঝে-মাঝে বলেন, হ্যাঁ, মানুষের মতো একখানা মানুষ বটে ভুবন রায়। যেমন রোখ, তেমনি ঝোঁক! ওরকম আর-একখানা মানুষ বানাতে পারলে বড় আনন্দ পেতাম। কিন্তু ছাঁচ ভেঙে ফেলেছি, আর তো হওয়ার নয়।”
“ছাঁচটা আবার কী?”
“প্রত্যেকটা মানুষের জন্য আলাদা-আলাদা ছাঁচ থাকে তো? যেই একটা তৈরি হয় অমনি ছাঁচ ভেঙে দেওয়াই নিয়ম। তাই একটার মতো আর-একটা হয় না কি না।”
ভুবন রায় খুব হাসলেন, বললেন, “তা বটে, আচ্ছা ওরা কি এর জন্য নোবেলটা আমাকেই দেবে?”
‘না দিয়ে যাবে কোথায়? একবার নয়, নোবেল আপনার বার-চারেক পাওয়া উচিত।”
ভুবন রায় চোখ কপালে তুলে বললেন, “বলো কী হে দৈববাণী! নোবেল চারবার! সে যে অনেক টাকা?”
“তা বলতে পারেন দু’কোটির কিছু ওপরেই হবে।”
“দু’কোটি!” বলে ভুবন রায় মাথাটা চেপে ধরে বসে পড়লেন।
“ঘাবড়াচ্ছেন কেন? দু’কোটি তো নস্যি। এ জিনিস বিক্রি করলে তো আরও কত কোটি আসবে গুনে শেষ করতে পারবেন না।”
উঃ, এ যে ভাবা যায় না। মাত্র কয়েক ঘণ্টার কাজে এত?”
“ভগবান যাকে দেন ছল্পর ছুঁড়ে দেন।”
“তাই দেখছি।”
“তারপর খ্যাতির কথাটাও ধরুন। পৃথিবীতে সবাই এক ডাকে ভুবন রায়কে চিনে যাবে।”
“তা তো বটেই।”
“সেটারও তো দাম হয় না।”
“খ্যাতি তো আছেই। তবে খ্যাতির বিড়ম্বনাও কম নয়।”
“তা ঠিক। খাত্যি বলেই দুনিয়ার সব দেশ ডাকাডাকি করবে। আজ আমেরিকা, কাল রাশিয়া, পরশু চীন। খুব ছোটাছুটি পড়ে যাবে।”
ভুবন রায় উজ্জ্বল হয়ে বলেন,”তা নাকি?”
“নাকি মানে? ডাক এল বলে।”
“তা হলে এখন কি একটু চড়ে দেখব?”
“এখন কী দরকার? দৈববাণী তো বলছে যন্ত্রটা তৈরি হয়ে গেছে। বাইরে এখন বেশ অন্ধকার। এ সময়ে ওড়াউড়ি করতে গেলে বাদুড় বা প্যাঁচার সঙ্গে ধাক্কা লাগতে পারে। বাদুড়ের আবার ধারালো নখ আছে।”
“ও বাবা, তা হলে থাক।”
“ইয়ে একটা কথা ছিল।”
“কী কথা?”
“এত বড় একটা কাজ করলেন, ভগবানকে কিছু দেবেন-টেবেন না?”
“ভগবান কিছু চান নাকি?”
“না, না, ওসব চাওয়া-টাওয়া তাঁর ধাতে নেই। তবে কিনা দেওয়াটাই দস্তুর।”
“তা দেব না কেন। সোয়া পাঁচ আনা বা পাঁচ সিকে দিলেই তো হয়।”
“এটা একটা কথা হল?”
“কেন আমরা তো ওই রেটেই পুজো দিই।”
“সে আপনার অর্ডিনারি পুজো। চার-চারটে নোবেল পেলে কি আর পাঁচ সিকেতে হয়! নোবেলের পিছনে ভগবানের খাটুনিটার কথাও ভাবনু। কত সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচের ছাঁচ বানাতে হয়েছিল।”
তা হলে পাঁচ টাকাই দেব না হয়।”
“ছিঃ ছিঃ, নজরটা একটু উঁচু করুন ভুবনবাবু। আপনার উচিত পাঁচ লাখ দেওয়া। আমরা না হয় আপনার সম্মানে কিছু কমিয়ে দিচ্ছি। পাঁচ হাজার।”
ভুবন রায় আবার মাথায় হাত দিলেন, “পাঁচ হাজার?”
“ওর কমে আজকালকার বাজারে কি চারটে নোবেল পাওয়া যায়! পাঁচজনকে জিজ্ঞেস করে দেখুন না!”
“না হে দৈববাণী, তোমার রেটটা বড্ড বেশি।”