দুলালবাবু হরেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তা হলে আসি ভায়া, দেখা হয়ে বড় আনন্দ পেলুম। আমার মায়ের দুলজোড়া যে তোমার কাছেই বাঁধা। সেটা ভেবে ভারি আনন্দ হচ্ছে। তোমার মতো ভাল লোক হয় না।”
হরেন ধমক মেরে বলল, “আর কথা বাড়িও না। কেটে পড়ো।”
“যাচ্ছি, যাচ্ছি। তাড়া দিতে হবে না বলে দরজার দিকে পা বাড়িয়েও দুলালবাবু ফিরে এলেন, “একটা কথা মনে পড়ল ভায়া। দারোয়ানটাকে বড্ড জোরে চেপে ধরে রেখেছিলুম, এখন কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে, সত্যি সত্যি মরে যায়নি তো? দ্যাখো তো নাকের সামনে হাত দিয়ে শ্বাস চলছে কি না! মরে গিয়ে থাকলে হ্যাপাটা তোমাকেই তো সামলাতে হবে।”
হরেন একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলে গেল। তারপর কী ভেবে একটু নিচু হয়ে লোকটার নাকের সামনে হাত রাখল।
এই সুযোগটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন দুলালবাবু। হরেন যেই নিচু হয়েছে অমনি তিনি হনুমানের মতো লাফ মেরে বেড়া ডিঙিয়ে সোজা তার ঘাড়ের ওপর পড়লেন। তারপরেই এক রদ্দা।
পাঁচু চোখ বুজে ফেলেছিল। সে চোর বটে, কিন্তু খুনে নয়। চোখ বুজেই সে বলল, “রক্ষে করুন দুলালবাবু, লোকটাকে মেরে ফেলবেন না।”
দুলালবাবু একগাল হেসে বললেন, “আরে না। এই দ্যাখো, লোকটার সেঁজের মধ্যে কত টাকা। বিশ-ত্রিশ হাজার তো হবেই।”
পাঁচু চোখ খুলে গদগদ হয়ে বলল, “বলেন কী! এ তো আমার ছ’মাসের রোজগারের চেয়েও বেশি। নাঃ, আপনি বাহাদুর বটে!”
দুলালবাবু হরেনের চাবি নিয়ে তাড়াতাড়ি সিন্দুক খুলে ফেললেন। তার মধ্যে বিস্তর সোনাদানা, দামি পাথর, রুপোর বাসন থরে থরে সাজানো।
“দ্যাখো হে পাঁচু।”
“আজ্ঞে দেখছি। চোখের পলক পড়ছে না। তবে দুলালবাবু, একটু হাত চালিয়ে। এসব কাজে সময় নিতে নেই।”
“সে কি হে পাঁচু। এই যে তুমি বলো আমি তাড়াতাড়ি করে কাজ পণ্ড করি।”
“আজ্ঞে সে কথাটাও ঠিক। কিন্তু এখন তাড়াতাড়ি না করলে লোকজন এসে পড়তে পারে।”
পাঁচু কথাটা শেষ করতে না করতেই দরজার বাইরে থেকে কার যেন গলা পাওয়া গেল, “হরেন, আছ নাকি হে!”
পরমুহূর্তে দেখা গেল, বিশাল চেহারার খাকি পোশাক-পরা একটা লোক দরজা জুড়ে দাঁড়াল, তারপরই বলে উঠল, “এ কী? এসব কী কাণ্ড?”
পাঁচু ফুট করে একটা আলমারির পাশে ঢুকে গাঢাকা দিল।
দুলালবাবু নির্বিকারভাবে সিন্দুক থেকে জিনিসপত্র বের করতে করতে বললেন, “আর বলবেন না দারোগাবাবু, দিনকাল যা পড়েছে আর কহতব্য নয়।”
দারোগাবাবু তাঁর রিভলভারের বাঁটে হাত রেখে বললেন, “তিন তিনটে লাশ পড়ে আছে, জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড, কী ব্যাপার? আর আপনিই বা কে?”
দুলালবাবু সোনারুপো সব গুছিয়ে হরেনের আলোয়ানে পোঁটলা বাঁধতে বাঁধতে বললেন, “চোখের সামনে ঘটনাটা ঘটে গেল দারোগাবাবু। ভয়ে তো আমার মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়। মায়ের একজোড়া দুল বাঁধা দিয়ে কয়েকটা টাকা ধার নেব বলে হরেনভায়ার কাছে এসেছিলাম। অনেকদিন বাদে দেখা তো, বসে বসে দুচারটে সুখ-দুঃখের কথাও বলছিলাম। এমন সময়ে চার-চারটে বন্দুকধারী ডাকাত এসে হাজির।”
“বলেন কী?”
“আজ্ঞে, তাই তো বলছি, দেশে আইনকানুন বলে আর কিছু রাইল না দারোগাবাবু। ভরসন্ধেবেলা হরেনভায়ার মতো একটা নিরীহ লোকের ওপর চড়াও হয়ে এসব কী কাণ্ড বলুন তো।”
দাবোগাবাবু তিনজন মূৰ্ছিত লোকের দিকে চেয়ে বললেন “এরা কি বেঁচে আছে?”
“বলতে পারছি না। না থাকারই কথা। আমি হরেনভায়ার জিনিসগুলো একটু গুছিয়ে দিচ্ছি। নেইও বিশেষ কিছু, সব চেঁছেপুঁছে নিয়ে গেছে। যা আছে তা ওর বউকে পৌঁছে দিয়ে আসি।”
“ডাকাতরা কোনদিকে গেল বলুন তো?”
“ওইদিকে। গেলে এখনও ধরে ফেলতে পারবেন।”
দারোগাবাবু তবু কূট সন্দেহের চোখে দুলালবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, “আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না, অথচ চেনা-চেনাও লাগছে।”
“অনেকেরই লাগে। ওটা কিছু নয় দারোগাবাবু, চোখের ভুল।”
“আমরা একটা সাঙ্ঘাতিক খুনিকে খুঁজছি। সে এই শহরেই কোথাও পালিয়ে আছে। সে ভাল ক্রিকেট খেলে, গায়ে ভীষণ জোর, প্রচণ্ড খেতে পারে, আর দেখতে অনেকটা সায়েন্সের মাস্টার দুলালবাবুর মতো। এরকম লোক কাউকে দেখেছেন নাকি?”
দুলালবাবু ভ্রূ কুঁচকে একটু ভেবে নিয়ে বললেন, “দাঁড়ান, দাঁড়ান! হুঁ হুঁ, ঠিক তো। চারজন ডাকাতের একজনের চেহারা তো বাস্তবিকই দুলালবাবুর মতোই! সে খুনি নাকি দারোগাবাবু? কী সর্বনাশ! খুব জোর বেঁচে গেছি তা হলে।”
দারোগাবাবু খাপ থেকে রিভলবারটা বের করে মাথা নেড়ে বললেন, “না, আপনি বেঁচে যাননি। বাঁচার কোনও উপায় আপনার সামনে নেই।”
দুলালবাবু মিষ্টি করে হেসে বললেন, “এত কম বয়সে তো কারও ভীমরতি হয় না দারোগাবাবু! আপনার হল কী করে?”
“ভীমরতি যে হয়নি তা আপনিও নির্ঘাত হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। এবার মানে-মানে পোঁটলাটা যেখানকার সেখানেই রেখে দু’হাত তুলে এগিয়ে আসুন, আপনাকে আমি অ্যারেস্ট করলাম।”
পোঁটলাটা ছেড়ে দুলালবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “গাড়লদের সঙ্গে কাজ করতে গেলে এরকমই হয় দারোগাবাবু। ওই যে দেখুন, আমার স্যাঙাত পাঁচু মোদক কেমন আলমারির আড়ালে ভালমানুষের মতো গা বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চেনেন তো ওকে? বিখ্যাত চোর। এখন কি ওর উচিত ছিল না একটা মুগুর টুগুর বা নিদেন একটা ইট দিয়ে পিছন থেকে আপনার মাথায় মারা? আপনিই বলুন! এই বিপদের সময় এটা কি বন্ধুর মতো কাজ হল? ছ্যাঃ ছ্যাঃ। দেশটার এই জন্যই কোনও উন্নতি নেই, বুঝলেন দারোগাবাবু! অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে যদি না পড়লি তা হলে আর মানুষ কিসের! তাই না দারোগাবাবু?”