বটকৃষ্ণ চোখ কপালে তুলে বললেন, “অ্যাঁ! কী বললে! এই বটকৃষ্ণ মণ্ডলের পরিচয় দিতে লজ্জা পায়! জানো, আমি যখন জামাই হয়ে প্রথম বিষ্ণুপুর গেলুম, তখন সেখানে ঘরে-ঘরে দেওয়ালি হয়েছিল? আমার এক মামাশ্বশুর কী বলেছিলেন জানো? বলেছিলেন, বটকৃষ্ণ বটগাছের মতো স্থির আর অবিচল! আর কৃষ্ণের মতোই বিচক্ষণ। আমার শাশুড়ি ঠাকরুন তো এখনও বলেন, বিট-র মতো জামাই চট করে দেখা যায় না। ওরে বাপু, ঝগড়াঝাটি আছে বটে, কিন্তু তা বলে হ্যাঁটা করার উপায় নেই।”
করালীডাক্তার ধীরেসুস্থে কুলকুচো সেরে কাঁধের গামছাখানায় মুখ মুছতে মুছতে বললেন, “অত কথায় কাজ কী মশাই? ছোঁকরাকে যদি আপনার শালা বলে মনে হয় তা হলে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান না!”
বটকৃষ্ণ বুক চিতিয়ে বললেন, “নিয়ে যাবই তো! এ তো আর তোমার শালা নয়। আমার শালাকে আমি নিয়ে যাব, কে আটকায় দেখি!”
বলে বটকৃষ্ণ সবেগে গিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লেন। একটু পরেই মাথা নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে এসে, “দুর দুর! সকালটাই নষ্ট!”
একটু পরেই রুদ্রাক্ষের মালা গলায় নবকুমার এসে পড়ল। মুখে বিনয় মাখানো হাসি। গলা খাটো করে রসস্থ মুখে বলল, “ডাক্তারবাবু! শুনলুম, কাল রাতে মথুরাপুরের রাজাবাহাদুর ছদ্মবেশে এসে আপনার বাড়িতেই উঠেছেন! কী সৌভাগ্য!”
করালীডাক্তারও গলা খাটো করে বললেন, “চুপ! চুপ! পাঁচজনে জানতে পারলে যে ধুন্ধুমার লেগে যাবে! কাউকে বলে দিয়ো না যেন!”
নবকুমার গ্যালগ্যালে মুখে বলল, “আরে না, না। এসব গুহ্য কথা কি পাঁচকান করতে আছে! তা এই অঘোরগঞ্জের মতো জায়গায় রাজা-গজার আগমন তো চাট্টিখানি কথা নয়! বলি আপ্যায়ন টাপ্যায়ন ঠিকমতো হচ্ছে তো! বলেন তো বাড়ির গোরুর দুধ একঘটি দিয়ে যেতে পারি। আর সীতাপতি ভাণ্ডারের বিখ্যাত কঁচাগোল্লা। রাজত্ব নেই বটে, কিন্তু তবু রাজা তো!”
“সে তো ঠিক কথাই হে নবকুমার। মরা হাতি লাখ টাকা।” নবকুমার বিদায় হওয়ার পর খুবই উৎকণ্ঠিত মুখে হাঁফাতে হাঁফাতে শিবকালীবাবু এসে হাজির। চোখ বড় বড় করে বললেন, “ওহে করালী, তোমার বাড়িতে নাকি বোমাবন্দুক নিয়ে কে এক উগ্রবাদী ঢুকে পড়েছে! এ তো সর্বনেশে কথা! বলি, তোমরা সব বেঁচেবর্তে আছ তো!”
করালী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আধমরা হয়ে আছি দাদা!”
“পুলিশে খবর পাঠিয়ে দিয়েছ তো!”
“এখনও দেওয়া হয়ে ওঠেনি বটে, একটু ফাঁক পেলেই থানায় গিয়ে খবরটা দিয়ে আসব।”
শিবকালী সবেগে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বললেন, “খবর দিয়ে কোনও লাভ নেই অবশ্য। উগ্রবাদী ঢুকেছে জেনে আমি সকালবেলাতেই থানায় হানা দিয়েছিলাম। মনোহর দারোগার কাঁঠাল খেয়ে পেট ছেড়েছে। উগ্রবাদী শুনেই আঁতকে উঠে বলল, “ওরে বাবা, উগ্রবাদীর মোকাবিলা করার সাধ্যি আমাদের নেই। থানায় মোট পাঁচটা বন্দুক, তার মধ্যে তিনটে মরচে ধরে ঠান্ডা মেরে গেছে। একটায় কুঁদো ভেঙেছে, আর-একটা চলনসই আছে বটে, কিন্তু তাতে ভরার মতো টোটা নেই। টোটাগুলো বহুঁকাল ব্যবহার না হওয়ায় বারুদ সেঁতিয়ে মাটি হয়ে গেছে। পাঁচজন সেপাইয়ের তিনজন দেশে গেছে, বাকি দু’জন দারোগাগিন্নির ফাঁইফরমাশ খাটতে ব্যস্ত। মনোহর বলেই দিল, “উগ্রবাদীর জন্য পুলিশের কী দরকার, আপনারা হুড়ো দিন, টিন, ক্যানেস্তারা পেটাতে থাকুন। পুলিশ আসছে বলে ভয় দেখান। দেখবেন ঠিক পালিয়ে যাবে।”
করালী বিরস মুখে বললেন, “তা অবশ্য যাবে। তবে তাড়া নেই। উগ্রবাদীটা এখন ঘুমোচ্ছে। আপনারা ততক্ষণে ক্যানেস্তারা ট্যানেস্তারা জোগাড় করুন, লোকজন জুটিয়ে আনুন।”
শিবকালী চোখ কপালে তুলে বললেন, “ঘুমোচ্ছ! উগ্রবাদীটা ঘুমোচ্ছে! এ তো ভাল কথা নয়! দেশটা যে অরাজকতায় ভরে গেল হে! জন্মে কখনও শুনিনি যে, উগ্রবাদীরা ঘুমোয়!”
করালী ব্যথিত গলায় বললেন, “ঠিকই বলেছেন, খাঁটি উগ্রবাদীই কি দেশে আর আছে?”
“না, এর একটা বিহিত করতেই হবে।” বলে উত্তেজিত শিবকালী প্রস্থান করলেন।
বেলা ন’টা নাগাদ হাতে একটা বল্লম নিয়ে ব্যায়ামবীর বিরজা এসে বলল, “করালীবাবু, শুনলুম ডাকাতটা নাকি আপনার বাড়িতেই লুকিয়ে আছে?”
“আছেই তো!”
“আপনি কি জানেন ওর মাথার দাম দশ হাজার টাকা?”
“এ তো পুরনো খবর। সবাই জানে।”
“ডাকাতটার কাছে বন্দুক-পিস্তল নেই তো!”
“তা আর নেই। কোমরে দুটো পিস্তল, আর ঝোলা ব্যাগে গোল গোল কী যেন দেখছিলাম বটে! বোমা হতেও পারে!”
বিরজা একটু দমে গিয়ে বলল, “আপনি বরং ওকে আমার কাছে সারেন্ডার করতে বলুন। সারেন্ডার করলে আমি বেশি কিছু করব না। শুধু আলগোছে নিয়ে গিয়ে সরকার বাহাদুরের হাতে জমা করে দেব।”
করালী সপ্রশংস গলায় বললেন, “তোমার মতো ডাকাবুকো ছেলেই তো গায়ের ভরসা। ডাকাতটার কপালে কষ্ট আছে দেখছি। কিন্তু আমি বলি কী, একটু রয়েসয়ে এগনোই ভাল। তুমি বীর এ তো সবাই জানে! আর বল্লমও ক্ষেত্রবিশেষে অস্ত্র হিসেবে মন্দ নয়। কিন্তু গুলিটুলি ছুটলে লেগেটেগে যেতে পারে তো!”
বিরজা দেড় পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, “বেশি দেরি করা কি ঠিক হবে? খবর চাউর হয়ে গেলে মেলা ভাগীদার জুটে যাবে যে!”
করালী গলা চুলকোতে-চুলকোতে বললেন, “সেটাও একটা চিন্তার কথা বটে! ডাকাত তো মোটে একটা। আর খবরও সবাই ৪৪
জানে কিনা! দশ হাজার টাকা যে কত ভাগে ভাগ হবে কে জানে! খুঁজে পেতে দ্যাখো তো আর দু-চারটে ডাকাত পাও কিনা!”