“না, না, মাত্র দুটো টাকার জন্য পশুপতির ওরকম করা উচিত হয়নি!”
“হ্যাঁ। পরে অবশ্য ঠান্ডা হয়ে তিনি চা-ও খাইয়েছেন। তাই বলছিলুম, বোকা হওয়ার কিছু সুবিধেও আছে মশাই!”
“তাই দেখছি। তা এসো, আমার সাধনপীঠে একটু বসে যাও। এক ভক্ত একছড়া কলা দিয়ে গেছে। দুটো কলা খেয়ে দেখবে চলো।”
বগলাপতির সাধনপীঠ বেশ নিরিবিলি জায়গা। সামনেই বিদ্যেধরীর ঘাট। গোটা কয়েক বটগাছ আছে, কাছেই শ্মশান, বগলাপতির একখানা কুটির আছে, আঙিনায় একখানা পাথর বাঁধানো বেদি।
এত রাতে বগলাপতির ভক্তরা কেউ থাকে না। কিন্তু ধুনির আলোয় দেখা গেল বেদির সামনে ধুতি আর শার্ট পরা একজন লোক বসে আছে। তাকে দেখে বগলাপতি ভারী খুশি হয়ে বললেন, “কামাখ্যা নাকি রে? বহুদিন পর দেখা! তা এত রাতে কী মনে করে?”
সিঁড়িঙ্গে চেহারার হাড়গিলে লোকটা কাঁচুমাচু মুখ করে বিরস গলায় বলল, “কামাখ্যা নই মশাই, আমার নাম বৃন্দাবন।”
বগলাপতি খানিকক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে বললেন, “বৃন্দাবন! বৃন্দাবনটা আবার কে? স্পষ্ট দেখছি সামনে কামাখ্যা বসে আছে, আর বলছিস, তুই বৃন্দাবন? আমার চোখে চালসেও ধরেনি, ভীমরতিও হয়নি।”
“আজ্ঞে, আমি নিয্যস বৃন্দাবনই বটে! আপনার ভুল হচ্ছে।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বগলাপতি বেদির উপর পাতা কুটকুটে কম্বলের আসনে আসনপিড়ি হয়ে বসে বললেন, “কামাখ্যা হল নীলপর্বতে, প্রাগজ্যোতিষপুরের কাছে। আর বৃন্দাবন হল সেই উত্তরাখণ্ডে, হস্তিনাপুর না কী যেন জায়গাটা, তার কাছে। তা কামাখ্যা ছেড়ে তুই বৃন্দাবনগামী হলি কবে?”
জামার তলায় কোমরে প্যাচানো গামছাখানা খুলে এনে লোকটা মুখ মুছে বলল, “কারণ আছে। আমার বড় বিপদ, আমি হলুম চর হেতমপুরের বৃন্দাবন ঘোষ।”
“দ্যাখ কামাখ্যা, তুই যদি বৃন্দাবন হোস, তবে আমিও গাঁধীজি। যদি ভেবে থাকিস যে বুড়ো বয়সে আমার স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে, তা হলে ভুল করবি। কারণ, আমি বুড়ো হইনি। মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে বুড়ো হওয়া শক্ত।”
পাশ থেকে লালমোহনবাবু অত্যন্ত উদ্বেগের গলায় বলে উঠলেন, “গেল হপ্তায় যে বললেন ছাপ্পান্ন!”
“বলেছিনাকি? ওরে বাপু, আত্মার বয়সও হয় না, সে বুড়োও হয়, মরে না, জন্মায় না। নৈনং ছিদ্দন্তি শস্ত্রাণি, নৈনং দহতি পাবকঃ। মানে জানো? ওর মানে হচ্ছে আত্মা অজর অমর। তার আটচল্লিশই বা কী আর ছাপ্পান্নই বা কী?”
লালমোহনবাবু ভারী অবাক হয়ে বললেন, “তা হলে এই লোকটার বৃন্দাবন হতে আটকাচ্ছে কীসে? আত্মার বৃন্দাবনই বা কী, কামাখ্যাই বা কী!”
“আটকায় হে আটকায়, আইনে আটকায়!” হাড়গিলে লোকটা বলল, আমি কামাখ্যা না হয়ে বৃন্দাবন হলে কার কী ক্ষতি হচ্ছে বলুন তো! দুনিয়া তো আর উলটে যাচ্ছে না, চন্দ্র-সূর্যও উলটো বাগে উঠবে না।”
বগলাপতি নিমীলিত চোখে চেয়ে বললেন, “অত বড়বড় কাণ্ড
হলেও ছোটখাটো ফ্যাকড়া তো বাধতে পারে। তা হ্যাঁ রে কামাখ্যা, চুরি-ডাকাতি করে ফেরার হয়েছিস, নাকি খুনখারাবি করে এসেছিস?”
কামাখ্যা ওরফে বৃন্দাবন অত্যন্ত উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, “খুনটা আমি করতে যাব কেন! করল তো বাটু পরিহারের লোক!”
বগলাপতি একটা শ্বাস ফেলে বললেন, “তাই বল। তা হলে খুন একটা হয়েছে।”
লোকটা কিছুক্ষণ গুম মেরে মাথা নিচু করে বসে রইল। তারপর মুখ তুলে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “আমার যে বড় বিপদ বগলাদাদা!”
“খোলসা হ’ কামাখ্যা, খোলসা হ’। কথা যত চেপে রাখবি তত মুশকিলে পড়বি। খুনটা হল কে?”
“আজ্ঞে, তা জানি না। ফরসামতো একটা লোক, লম্বাপানা।”
“নিজের চোখে দেখলি?”
“দেখার ইচ্ছে ছিল না দাদা,তবে দুপুরে নদীর ধারের মাঠে গোরু বাঁধতে গিয়ে দেখি,দুটো মুনিশ গোছের লোক আর-একটা লোককে মাটিতে ফেলে গলা টিপে মারছে।”
লালমোহনবাবু চুকচুক করে একটা আপশোশের শব্দ করে বললেন, “এ, নিজের চোখে একটা খুন দেখব বলে কত কালের ইচ্ছে আমার। ডাকাতি দেখা হয়ে গেছে, এখন একটা খুন দেখতে পেলেই–”।
কামাখ্যা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “সে সাধ আমারও ছিল মশাই। কিন্তু এ খুনটা দেখার পর সাধ ঘুচে গেছে। এখন নিজে কবে খুন হয়ে যাই সেই ভয়ে মরছি।”
বগলাপতি বিরক্ত হয়ে বলল, “অন্য লোকে খুন হল বলে তোর বিপদ কীসের? তুই খুন হবি কেন?”
“আমি যে খুনের সাক্ষী! তারা আমাকে চিনেও রেখেছে।”
বগলাপতি মাথা নেড়ে হতাশ গলায় বললেন, “কেন যে খুনটুনগুলো দেখতে যাস কে জানে বাবা! খুন কি দেখার জিনিস? এ তো আর থিয়েটার বায়োস্কোপ নয় রে বাপু। তা খুনিগুলো কি তোকে শাসিয়েছে নাকি?”
মাথা নেড়ে কামাখ্যা বলল, “নাঃ। বরং দুর্বুদ্ধির বশে আমিই একটা কাঁচা কাজ করে ফেলেছি!”
“কী কাজ?”
“ভাবলুম মতিলালের জমিটা বায়না করে রেখেছি, টাকার জোগাড় নেই বলে রেজিস্ট্রি হচ্ছে না। তা এই মওকায় পেঁয়ো খুনিগুলোর কাছ থেকে কিছু কেঁপে নিই। খুন-হওয়া লোকটার গলায় সোনার চেন, হাতে হিরের আংটি, পকেটে পুরুষ্টু মানিব্যাগ দেখে লোভ সামলাতে পারিনি। ফস করে হাজার টাকা চেয়ে বসলাম। শাস্ত্রেই আছে বর্বরস্য ধনক্ষয়ং’।”
“বলিস কী? তুই তো ডাকাত! টাকাও খেয়েছিস?”
“না দাদা, বলল, তারা বাটু পরিহারের লোক, তার হুকুম না হলে টাকা দিতে পারবে না। শুনেই তো আমার হাত-পা সিঁটিয়ে গেল। কেঁপেকেঁপে অস্থির। বাটুর কানে যদি কথাটা ওঠে তা হলে আমার কী দশা হবে তা বুঝতে পারছেন?”