“ডাক্তারের কাজ হল ছলে-বলে-কৌশলে রোগীর প্রাণরক্ষা করা। শুধু নিদান লিখে দিয়ে পকেটে পয়সাটি পুরলেই ডাক্তারি হয়।! রোগী ওষুধ ঠিকমতো খেল কি না, পথ্যিতে গণ্ডগোল করল কি
সেটা দেখাও ডাক্তারের কর্তব্য। লোকে আমাকে অপছন্দ করতে পারে, কিন্তু কেউ কখনও বলতে পারবে না যে, করালীডাক্তার পয়সা নিয়ে মিথ্যে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দিয়েছে বা স্যাম্পেল ওষুধ বাজারে বিক্রি করেছে।”
‘তুমি ভাল লোক হলেও হতে পার, কিন্তু ভ ভদ্রলোক মোটেই নও। ভ ভদ্রলোক কি কখনও গুন্ডামি করে বেড়ায়, নাকি লোকের উপর হামলা করে? আচ্ছা, নবকিশোরের দোষটা কী ছিল বলো? তোমার চেম্বারে বসে সে বিনোদডাক্তারকে প্রশংসা করছিল, তাতে দোষটা কী? সে মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল, “দেশটা তো জালি ডাক্তারে ভরে গিয়েছে, তার মধ্যে বিনোদডাক্তার যেন বাতিঘর। কিন্তু মিছে কথাও বলেনি। বিনোদ অতি সজ্জন, অমায়িক, ডাক্তারও ভাল। আর তুমি কী করলে? এই কথা শুনে খেপে গিয়ে নবর গলার চাঁদর ধরে মুচড়ে কী ঝাঁকুনিটাই দিচ্ছিলে! ঘাড় মটকে মরেই যেত। অন্য লোকেরা এসে তোমার হাতে-পায়ে ধরে তাকে বাঁচায়।”
“ও তুমি বুঝবে না। নব ইচ্ছে করেই ওসব বলছিল। অতি উচ্চাঙ্গের বদমাশ।”
এই সময়ে করালীডাক্তারের স্ত্রী সুরবালা দু’ কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকে বললেন, “আচ্ছা, দুটো লোক এক নাগাড়ে বিশ বছর ধরে কী করে ঝগড়া করতে পারে তা আমাকে বুঝিয়ে বলবেন? ঝগড়ার বহর দেখে তো আমি রোজ ভাবি, এবার বোধ হয় দু’জনে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গেল! ওমা, কোথায় কী, পরদিনই দেখি দু’জনে আবার কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে বসে গিয়েছে! এত ঝগড়া, তবু দেখি দুজনে দুজনকে একদিনও না দেখে থাকতে পারেন না?”
করালীডাক্তার গম্ভীর মুখে বললেন, “হুঁ, ওরকম একটা ধাপ্পাবাজ দু’নম্বরি লোকের মুখ দেখলেও পাপ হয়। হায়া লজ্জা নেই কিনা, তাই বিনা পয়সায় চা খেতে আসে।”
সুরবালা রাগ করে বললেন, “ছিঃ, ওকথা বলতে আছে? ঠাকুরপো জ্যোতিষী করেন বটে, কিন্তু কারও কাছ থেকে পয়সা নেন না। আর চায়ের খোঁটা দিচ্ছ? ঠাকুরপোর বাড়িতে ভাল পদ রান্না হলে, পিঠে-পায়েস হলে যে বাটি ভর্তি করে নিজে বয়ে এসে দিয়ে যান, সেটা বুঝি কিছু নয়?”
করালী অত্যন্ত গম্ভীর মুখে একটু তাচ্ছিল্যের হুঁ, দিয়ে চুপ করে গেলেন।
সুরবালা বললেন, “আপনি কিছু মনে করবেন না ঠাকুরপো!”
মৃদু হেসে অতি মোলায়েম গলায় জটেশ্বর বললেন, “অন্য রকম হলেই মনে করতুম বউঠান। বাঘের গায়ে যদি বোঁটকা গন্ধ না থাকে, বঁড় যদি লাল রং দেখে তেড়ে না আসে, গরিলা যদি নিজের বুকে থাবড়া না মারে, তা হলেই চিন্তার কথা। তেমনই করালী যদি হঠাৎ ভ ভদ্রলোক হয়ে ওঠে, তা হলে তাকে করালী বলে চেনা যাবে কি?”
সুরবালা হেসে চলে গেলেন। করালীডাক্তার দাঁত কড়মড় করে বললেন, “আমার বাড়ির লোকের আশকারা পেয়েই তোমার আম্পদ্দা দিনে-দিনে বাড়ছে।”
জটেশ্বর চায়ে চুমুক দিয়ে একটা আরামের শব্দ করলেন, “আঃ!” ঠিক এই সময় ফটকের ওপাশে রাস্তায় একটা গোরুরগাড়ি এসে থামল। দু’জন মুনিশগোছের লোক একজন প্যান্ট আর পাঞ্জাবি পরা লোককে ধরে ধরে গাড়ি থেকে নামাল।
চায়ের কাপ শেষ করে জটেশ্বর চুকচুক শব্দ করে বললেন, “আহা রে, কার এমন ভীমরতি হল যে, তোমার কাছে চিকিচ্ছে করাতে আনছে! উঁহু, এ গাঁয়ের লোক নয়। এ গাঁয়ের লোক হলে এমন দুর্মতি হত না!”
যার উদ্দেশে বলা সেই করালীডাক্তার কিন্তু কথাটা শুনতে পেলেন না। তিনি দূর থেকে তীক্ষ্ণ চোখে মাঝখানের লোকটাকে নিরীক্ষণ করতে করতে আপন মনে স্বগতোক্তির মতো বললেন, “জলেডোবা কেস। মেমোরি লস, হেমারেজ।”
চায়ের কাপটা রেখে জটেশ্বর বললেন, “বাঃ, দূর থেকেই যখন ডায়াগনোসিস করে ফেললে তখন নিদানটাও হেঁকে বলে দাও। রোগীকে আর নেড়েঘেঁটে দেখার দরকার কী? ফটক থেকেই বিদেয় হয়ে যাক।”
করালীডাক্তার কথাটায় কান দিলেন না। উঠে পড়তে-পড়তে বললেন, “না হে, দেখতে হচ্ছে।”
শঙ্কাহরণ আর বিপদভঞ্জন লোকটাকে বারান্দায় এনে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে হাত কচলাতে কচলাতে করালীকে বলল, “বিদ্যেধরী থেকে তুলেছি আজ্ঞে, আপনার কাছেই নিয়ে এনে ফেললাম!”
“বেশ করেছ। কেন, আমার বাড়িটা কি ধর্মশালা, না লঙ্গরখানা?” দু’জনেই মিইয়ে গেল খুব। শঙ্কাহরণ মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল, “বড়ঘরের মানুষ বলে মনে হচ্ছে, তাই ভাবলুম আমাদের কুঁড়েঘরে তো তোলা যায় না, আর খাওয়াবই বা কী? আমাদেরই জোটে না, তাই!”
চেয়ারে বসেই লোকটার ঘাড় লটকে গেছে, চোখ বোজা।
করালীডাক্তার গম্ভীর গলায় বললেন, “ও পাশে রুগির ঘরে নিয়ে বেডে শুইয়ে দে। আধমরা করে তো এনেছিস!”
জটেশ্বরও বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে এসে লোকটাকে দেখলেন। তারপর বললেন, “এ তত বড়ঘরের মানুষ বলেই মনে হচ্ছে হে। হাতে দামি ঘড়ি, আঙুলে হিরের আংটি!”
ভাগ্যিস এগুলো বলতে তোমার জ্যোতিষ বিদ্যে লাগে না। কিন্তু ঘড়ি আর আংটি ছাড়াও লক্ষ করার আরও বিষয় আছে, বুঝলে। সিল্কের জামাটার একটা ফুটো দেখতে পাচ্ছ? ওটা বোধ হয় বুলেট ইজুরি।”
তারপর করালী শঙ্কাহরণ আর বিপদভঞ্জনকে বললেন, “জামা, গেঞ্জি খুলে শোওয়াবি।”
দুজনে তাড়াতাড়ি লোকটাকে চ্যাংদোলা করে বারান্দার লাগোয়া সিক রুমে নিয়ে গেল।