যদিও জটেশ্বরকে দেখলেই করালীডাক্তার তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন, তবু প্রতিদিনই বিকেলের দিকটায় জটেশ্বরের একবার করালীডাক্তারের বাড়ি এক কাপ চা খাওয়া চাই-ই। কারণ, করালীর ২০
বাড়ির চা অতি বিখ্যাত। যেমন সুগন্ধ, তেমনই স্বাদটা অনেকক্ষণ জিভে লেগে থাকে।
আজ করালীডাক্তারের বাড়িতে গিয়ে হাজির হতেই করালী হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন, “তুমি তো একটা খুনি! তোমার ফাঁসি হওয়া উচিত।”
জটেশ্বর বিন্দুমাত্র উত্তেজিত না হয়ে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন, “আহা, সে হবে’খন। অত তাড়াহুড়ো কীসের? আমার গলাও আছে, ফঁসির দড়িও পালিয়ে যাচ্ছে না। বলি, হয়েছেটা কী?”
“কী হয়নি? আমার রুগি গোপীবল্লভবাবুকে যে তুমি খুন করেছ, সেটা কি জানোনা?”
“খুন হয়েছেন বুঝি! যাক, কানাঘুষো শুনছিলাম বটে! এই তোমার কাছে পাক্কা খবর পেলাম।”
“কানাঘুষো শুনছিলে! কীসের কানাঘুষো?”
“ওই যা সব সময় শোনা যায় আরকী! লোকে ফিসফাস করছে, করালীডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় গোপীবাবুর প্রাণটা বেঘোরে গেল!”
করালী মারমুখো হয়ে আস্তিন গুটিয়ে তেড়েফুড়ে উঠতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আস্তিন গুটোতে গিয়ে দ্যাখেন, তাঁর গায়ে জামা নেই, শুধু একটা স্যান্ডো গেঞ্জি। আর স্যান্ডো গেঞ্জির আস্তিন গুটনো যে ভারী শক্ত কাজ এ কে না জানে। তিনি দাঁত কড়মড় করে বললেন, “যারা ওকথা বলে তাদের জিভ টেনে ছিঁড়ে নিতে হয়। তাদের নাম বলল, আমি তাদের ব্যবস্থা করছি।”
জটেশ্বর আদুরে গলায় বললেন, “তুমি যে গুন্ডা প্রকৃতির লোক একথা সবাই জানে। এখন আসল কথাটা ভেঙে বলো তো!”
“তুমি পরশুদিন গিয়ে গোপীবাবুকে বলে আসোনি যে, নরহরি
চাকলাদারের সঙ্গে তাঁর যে পাঁচ লাখ টাকার সম্পত্তি নিয়ে মামলা চলছে তাতে তিনি নির্ঘাত জিতবেন। বলোনি?”
জটেশ্বর অবাক হয়ে বললেন, “বলেছি বইকী? গুনে দেখলুম, একেবারে জলবতরলং ব্যাপার। মামলায় জিত কেউ আটকাতে পারবে না।”
“তুমি কি জানো যে, তোমার ভবিষ্যদ্বাণী শুনেই উনি রাতে হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যান?”
“কেন, মামলায় কি গোপীবাবুর জেতার ইচ্ছে ছিল না?”
“খুব ছিল। কিন্তু তোমার ফোরকাস্ট শুনেই উনি বুঝলেন যে, জেতার কোনও আশাই নেই। আর তাই টেনশনে হার্ট অ্যাটাক!”
অতি উচ্চাঙ্গের একটি হাসি হেসে জটেশ্বর বললেন, “তা হলে কি বলতে চাও লোকে আমাকে উলটো বোঝে?”
“না, লোকে তোমাকে ঠিকই বোঝে। আর তাই উলটো করে ধরে নেয়। তুমি কি জানো যে, তুমি একজন ধাপ্পাবাজ? তুমি না জানলেও ক্ষতি নেই। লোকে জানে।”
জটেশ্বরের বিচলিত হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। মুখে ভারী মিষ্টি একটু হাসি। মিষ্টি করে বললেন, “মুখে যাই বলল করালী, মনে-মনে যে তুমি আমাকে শ্রদ্ধা করো তা আমি জানি।”
করালীবাবু হা হয়ে গেলেন। তারপর স্তম্ভিত গলায় বললেন, “শ্রদ্ধা! তোমাকে!”
জটেশ্বর মৃদু-মৃদু হেসে বললেন, “তুমি দুর্মুখ বটে, ডাক্তার হিসেবেও অচল, তবে লোকটা তো আর খারাপ নও। সেই কুড়ি বছর আগে যখন তুমি এখানে এসে থানাগেড়ে বসলে, তখনই তোমাকে বলেছিলুম কিনা, ‘ওহে করালী, প্রথমটায় তোমার খুব পসার হবে ঠিকই। তবে রাখতে পারবে না!’ কথাটা ফল কিনা দেখলে তো!”
“ধাপ্পাবাজির আর জায়গা পেলে না? তোমাকে আমি কস্মিনকালেও হাত দেখাইনি, কোষ্ঠীবিচারও তোমাকে দিয়ে করাইনি। তোমার আগড়মবাগড়ম কথাকে পাত্তাও দিইনি। আর পসার কমেছে তোমাকে কে বলল? এখনও মরণাপন্ন রুগির জন্য সবাই আমার কাছে এসেই ধরনা দেয়।”
“আহা, চটো কেন ভায়া! আমিও তো সর্দিকাশি বা জ্বরজাড়ি হলে অনিচ্ছে সত্ত্বেও ক্ষমাঘেন্না করে তোমার ওষুধ বার কয়েক খেয়েছি। তাতে কাজ না হলেও বন্ধুকৃত্য বলেও তো একটা কথা আছে নাকি! কিন্তু সেই যে বনবিহারী ঘোষের সান্নিপাতিকের সময় তুমি তাকে ঘাড় ধরে নিয়ে গিয়ে পুকুরের জলে চোবালে, তারপর পুকুর থেকে তুলে গায়ে ফুটন্ত গরম জল ঢাললে, ফের পুকুরে ডোবালে, ফের তুলে গরম জল ঢাললে- ও কাজটা তোমার মোটেই ঠিক হয়নি।”
“তার তুমি কী বুঝবে? বনবিহারীর টাইফয়েড এমন জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, বাঁচার কথাই নয়। ওই অল্টারনেটিভ বাথ দেওয়ায় প্রাণে বেঁচে যায়। বনবিহারী রাজি হচ্ছিল না বলে তাকে প্রাণে বাঁচাতে একটু জুলুম করতে হয়েছিল, এই যা!”
“তা বটে। তবে প্রাণে বাঁচলেও বনবিহারী সেই থেকে তোমার মুখদর্শন করা বন্ধ করেছে তা জানো? তারপর ধরো, খগেন হাওলাদার। সে ঘড়ি ধরে ওষুধ খায়নি বলে তুমি তার গলা টিপে ধরেছিলে। খগেনের জিভ বেরিয়ে যায়। আর-একটু হলেই তুমি খুনের দায়ে পড়তে!”
“খগেন অতি বজ্জাত। হাই শুগার হওয়া সত্ত্বেও সে লুকিয়ে রসগোল্লা খেত। গলা টিপে ধরায় সে ভয় খেয়ে মিষ্টি ছেড়েছে। তাতে তার মঙ্গলই হয়েছে।”
“তা হয়তো হয়েছে। কিন্তু খগেন যে তোমার নামে পুলিশে রিপোর্ট করেছিল তাও তো আর মিথ্যে নয়। তারপর ধরো উপেন দাস। তাঁর কোষ্টকাঠিন্যের জন্য তুমি তাঁকে গ্লিসারিন সাপোজিটারি দিয়েছিলে। দোষের মধ্যে সে জিজ্ঞেস করেছিল দিনে ক’টা করে খেতে হবে। তাতে খাপ্পা হয়ে তুমি তাকে এমন তাড়া করেছিলেন যে, সে ছুটে গিয়ে বিদ্যাধরীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচায়। কাজটা কি উচিত হয়েছিল হে করালী? লোকে কি আর সাধে বলে করালডাক্তার’!”