আরও আধঘণ্টা যত রকম প্রক্রিয়া জানা ছিল সবই কাজে লাগাল তারা। খুব ধীরে ধীরে অবশেষে শ্বাস পড়তে শুরু করল, নাড়ি ক্ষীণ হলেও চালু হল, বুকে ধুকপুকুনি হতে লাগল। এবং আরও খানিকক্ষণ পরে শেষে লোকটা চোখও মেলল। তবে চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে, ফ্যালফ্যালে চাউনি।
বিপদভঞ্জন ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, “কেমন লাগছে এখন?”
লোকটা জবাব দিতে পারল না বটে, তবে চোখ পিটপিট করতে লাগল।
শঙ্কাহরণ মস্ত শাস ফেলে বলল, “যাক, বেঁচে আছে?”
“তা তো হল, কিন্তু একে নিয়ে এখন করবি কী? অঘোরগঞ্জ পর্যন্ত যদি নিয়ে যেতেও পারি তবে থাকবে কোথায়? আমাদের কুঁড়েঘরে কোনওক্রমে রাখতে পারি বটে, কিন্তু খাওয়াব কী?
আমাদেরই পেট-ভাতের জোগাড় নেই!”
শঙ্কাহরণ ওরফে শঙ্কা বলল, “অত আগবাড়িয়ে ভাবছিস কেন? লোকটার চেহারা দেখছিস না, আমাদের মতো এলেবেলে লোক নয়। গাঁয়ে নিয়ে গিয়ে হাজির করলে গাঁয়ের লোকই ব্যবস্থা করবে। একটু সুস্থ হলে নিজের জায়গায় ফিরে যাবে। বড়জোর একটা রাত।”
“তা অবিশ্যি ঠিক। ও মশাই, উঠে বসতে পারবেন? এখানে পড়ে থাকলে তো চলবে না!”
লোকটা কিছু বুঝতে পারল বলে মনে হল না। তবে দৃষ্টিতে যেন একটু নজর এল। তাদের দিকে চেয়ে দেখল একটু। খুব দুর্বলভাবে যেন উঠে বসবারও চেষ্টা করল। দু’জনে দু’ধার থেকে সাবধানে ধরে বসাল তাকে। লোকটা বসে রইল, পড়ে গেল না।
“দাঁড়াতে চেষ্টা করুন তো! চেষ্টা করলে পারবেন।” দু-তিনবারে হল না বটে, কিন্তু চতুর্থবারের চেষ্টায় লোকটা উঠে দাঁড়াল। এবং একটু পরে দুর্বল পায়ে একটু হাঁটতে শুরু করল।
বিপদভঞ্জন বলল, “এই তো পেরেছেন! এই মাঠটুকু পেরোলেই গোরুরগাড়ি পেয়ে যাব।”
লোকটা এ পর্যন্ত একটাও কথা কয়নি। এখনও কোনও জবাব দিল না।
“ও শঙ্কু, কথা কইছে না কেন রে?”
“মাথাটা এখনও ভাল কাজ করছে না। বেশিক্ষণ ডুবে থাকলে যেন কী সব গণ্ডগোল হয় মগজে।”
“কোথায় নিয়ে তুলবি বল তো?”
“যেতে-যেতে ভাবব।”
“করালীডাক্তারের কাছে নিয়ে হাজির করলে হয় না? লোকটা বিটকেল বটে, কিন্তু মনটা ভাল!”
“যদি তাড়া করে?”
“কাউকে কাউকে তাড়া করে বটে, কিন্তু তোকে বা আমাকে তো করেনি? বরং বাগানের জঙ্গল সাফ করতে, পুকুরের পানা তুলতে বা সুপুরি আর নারকোল পাড়তে আমাদেরই তো ডেকে পাঠায়?”
“কিন্তু নতুন লোক দেখলে বিগড়ে যেতে পারে। তবে বলছিস যখন করালীডাক্তারের কাছেই চল! পসার নেই বটে, তবু ডাক্তার তো! ওষুধপত্র দিয়ে মানুষটাকে তাড়াতাড়ি চাঙা করে তুলতে পারে।”
২. জ্যোতিষী হিসেবে জটেশ্বর ঘোষাল
জ্যোতিষী হিসেবে জটেশ্বর ঘোষালের খুবই নামডাক। গণনা করে যা বলেনটলেন একেবারে অব্যর্থ। ফলবেই কি ফলবে। তবে তার মধ্যেও একটু কথা আছে। ফলে বটে, তবে উলটো রকমে। এই যেমন পরীক্ষায় ফল বেরোবার আগে কাঁচুমাচু মুখে পালবাড়ির ছোট ছেলে ফটিক এসে বলল, “জ্যাঠামশাই, হাতটা একটু দেখে দেবেন? রেজাল্টের জন্য বড় ভয় হচ্ছে।”
জটেশ্বর গম্ভীর মুখে খুব ভাল করে ফটিকের হাত দেখলেন, অনেক হিসেবনিকেশ করলেন, তারপর ভ্রু কুঁচকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “না রে, এবারটায় হবে না।”
শুনে ফটিক লাফিয়ে উঠে দু’ পাক তুর্কি নাচ নেচে, “মেরে দিয়েছি! মেরে দিয়েছি!” বলে চেঁচাতে-চেঁচাতে বেরিয়ে গেল। এবং রেজাল্ট বেরোবার পর বাস্তবিকই দেখা গেল, ফটিক বেশ ভাল নম্বর পেয়ে পাশ করেছে।
নবারুণ ক্লাবের ফুটবল ক্যাপ্টেন গত দু’বছর ধরে আন্তঃজেলা ফুটবলের শিল্ড জিততে না পারায় একদিন জটেশ্বরের কাছে এল। বলল, “কাকামশাই, এবারও কি শিন্ডটা আমাদের ভাগ্যে নেই?”
জটেশ্বর ফের গণনায় বসলেন। অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে ক্লাবের জন্মমুহূর্ত থেকে একটা ঠিকুজিও করে ফেললেন। এবং বললেন, “উঁহু, শিল্ড এবারও তোদের কপালে নেই!”
সেই খবর শুনে ক্লাবে সে কী উল্লাস! হিপহিপ হুররে, জিন্দাবাদ
ইত্যাদি ধ্বনির সঙ্গে রসগোল্লা বিতরণও হয়ে গেল। শেষ অবধি নবারুণ ক্লাব শিল্ডও জিতেছিল।
গণেশবাবুর সেবার যায়-যায় অবস্থা। ডাক্তার ভরসা দিচ্ছে না। উইলটুইল করে ফেলেছেন। একদিন জটেশ্বরকে ডাকিয়ে এনে বললেন, “বাপু জটেশ্বর, কোষ্ঠীটা একটু ভাল করে দ্যাখো তো! মৃত্যুযোগটা কি এগিয়ে এল?”
জটেশ্বর কোষ্ঠী নিয়ে বসে গেলেন। বিস্তর ক্যালকুলেশনের পর মাথা নেড়ে বললেন, “না গণেশখুড়ো, মৃত্যুযোগ তো দেখছি না!”
শুনে গণেশবাবুর মুখ শুকনো। বাড়িতে কান্নার রোল উঠল। গণেশবাবু ক্ষীণ গলায় বললেন, “একটু ভাল করে দ্যাখো হে! অনেক সময় রিস্টিগুলো ঘাপটি মেরে থাকে। খুঁজে দ্যাখো, লুকোছাপা করে কোনও কোনায় ঘুপচিতে গা-ঢাকা দিয়ে আছে কি না। ডাক্তার যে জবাব দিয়ে গিয়েছে!”
জটেশ্বর ফের হিসেব নিয়ে বসলেন এবং ঘণ্টাখানেক গলদঘর্ম হয়ে অবশেষে বললেন, “হ্যাঁ খুড়ো, একটা মঙ্গল আর রাহুর অবস্থানের যোগ পাচ্ছি বটে! তা হলে তো সামনের পূর্ণিমাতেই…”
গণেশবাবুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বাড়িতেও ভারী আনন্দের লহর বয়ে গেল। এবং গণেশবাবু আজ সকালেও অভ্যাসমত চার মাইল প্রাতভ্রমণ করেছেন।
আর এই জন্যই জটেশ্বরের নামডাক। অন্য জ্যোতিষীরা দশটা ভবিষ্যদ্বাণী করলে দু’-চারটে মিলে যায়। কিন্তু জটেশ্বরের দশটার মধ্যে দশটাই ভুল হয়। এই জন্যই শুভ কাজের আগে জটেশ্বরের কাছে গিয়ে লোকে হাত বা কোষ্ঠী দেখিয়ে নেয়।