শঙ্কাচরণ আর বিপদভঞ্জন দু’পাশ থেকে বলে উঠল, “কী হল বগলাঠাকুর?”
“কে ডাকল বল তো!”
“কে ডাকবে? ভুল শুনেছেন।”
“তাই হবে!” বলে বগলাপতি ফের এগোতে লাগলেন। হঠাৎ ফের সেই কণ্ঠস্বর, “বলি ও বগলা! বেশ স্পষ্ট শুনছ তো আমার গলা?”
“অ্যাঁ!” বলে ফের বগলাপতি দাঁড়িয়ে গেলেন।
শঙ্কা আর বিপদ মুশকিলে পড়ে গেল। শঙ্কা বলল, “বলি দিনেদুপুরে কি ভূতের ডাক শুনতে পেলেন নাকি বগলাঠাকুর।”
“চুপ! চুপ! শুনতে দে ভাল করে। কে যেন কী বলছে।” কণ্ঠস্বরটি বলল, “আমি যোগেন হে! মনে আছে?” বগলাপতি কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “যে আজ্ঞে! কিন্তু আ আমি যে মূৰ্ছা যাব…”
“খবর্দার ও কাজ কোরো না। তা হলেই কেলেঙ্কারি। মন দিয়ে শোনো। আমি তোমার ভিতরে ঢুকে পড়েছি। তোমার ভিতরটা অতি যাচ্ছেতাই। গাদাগাদা চর্বি জমে আছে চারধারে। ব্যায়াম ট্যায়ামের তো বালাই নেই তোমার। এ শরীরে বসবাস করতে তোমার ঘেন্না হয় না? যাকগে, কী আর করা। এখন কিছুক্ষণের জন্য ক্ষমাঘেন্না করে এই চর্বির পিণ্ডের মধ্যেই থাকতে হবে আমাকে।”
“ওরে বাবা! আমার ভিতরে যোগেন পালোয়ান! তা হলে মূৰ্ছা ঠেকাব কী করে?”
“মূৰ্ছা গেলে তোমার মুণ্ডু ছিঁড়ে নেব। স্টেডি হয়ে দাঁড়াও। অত কাঁপছ কেন? করালীর বাড়িতে দুটো গুন্ডা ঢুকছে। তাদের মতলব ভাল নয়। খুনখারাপি হতে পারে। তুমি পা চালিয়ে যাও। গুন্ডাদুটোকে দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। কোনও ভয় নেই।”
“বাপ রে! জীবনে গুন্ডা-পেটাই করিনি যে!”
“আহা, তোমাকে কিছু করতে হবে না। তোমার হয়ে লড়বে তো যোগেন পালোয়ান। বলি, গায়ে একটু জোরবল টের পাচ্ছ?”
“তা পাচ্ছি বোধ হয়।”
“তা হলে আর কী? মাভৈঃ বলে তেড়ে যাও তো!”
বগলাপতি হঠাৎ হুহুংকার দিয়ে বলে উঠলেন, “এই যাচ্ছি! দেখি তো কার এত সাহস যে অঘোরগঞ্জে এসে মস্তানি করে যায়?”
শঙ্কাচরণ আর বিপদভঞ্জন হাঁ হয়ে বগলাপতির ছুট দেওয়া দেখল, তারপর তারাও চটপট পিছু নিল।
বগলাপতি যখন অকুস্থলে পৌঁছলেন তখন চিরু আর শচি কাজ অনেকটাই এগিয়ে ফেলেছে। পিস্তলের বাঁট দিয়ে মেরে করালীডাক্তারকে অজ্ঞান করে দিয়েছে। পিস্তল বাগিয়ে সবে চিরু এগোচ্ছে ভোলানাথের দিকে। সুরবালা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন।
বগলাপতি ঝড়ের মতো ঢুকলেন, আর তার পরই তাঁর মুগুরের মতো ঘুসিতে চিরু ছিটকে পড়ল। পিস্তল খসে গেল হাত থেকে। বগলাপতি এবার শচির দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই দরজার কাছ থেকে কে যেন আর্তনাদ করে উঠল, “না না বগলাঠাকুর, ওকে মারবেন না, ওটা আমার ভাগে।” বলতে বলতেই গোপাল গুছাইত ঘরে ঢুকেই ল্যাং মেরে শচিকে ফেলে বুকের উপর চেপে বসে মোক্ষম এক ঘুমোয় তার চোখ উলটে দিল।
লড়াই শেষ। শঙ্কাচরণ আর বিপদভঞ্জন তাড়াতাড়ি দড়ি এনে দু’জনকে পাছমোড়া করে বেঁধে ফেলল।
জীবনে যিনি কখনও বগলাপতিকে চিটিংবাজ ছাড়া সম্বোধন করেননি, সেই করালীডাক্তারের আজ কী হল কে জানে, মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে উঠে দাঁড়িয়ে সবিস্ময়ে বগলাপতির দিকে চেয়ে বললেন, “ধন্যবাদ বগলাবাবু। আপনি সময়মতো না এলে এই ছেলেটা খুন হয়ে যেত। কিন্তু এসব কী হচ্ছে বলুন তো!”
ঠিক এই সময়ে ভোলানাথের টেলিপ্যাথি করালীডাক্তার থেকে শুরু করে সবাই শুনতে পাচ্ছিল। ভোলানাথ বলল, “এসব ঘটে বলেই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আলাদা একটা আস্বাদ আছে। আমাদের শতম গ্রহে আমরা পাঁচশো বছর বেঁচে থাকি বটে, কিন্তু বেঁচে থাকাটাকে আপনাদের মতো টের পাই না। আমার ভারী ভাল কাটল কয়েকটা দিন। মার খেলাম, গুলি খেলাম, প্রাণ বাঁচাতে পালালাম, বেশ লাগল কিন্তু। এবার আমার ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। ওই দেখুন, আমাকে নিয়ে যেতে নল এসে গেছে। আমি যাচ্ছি। কিন্তু ফের কখনও আসব। বারবার আসব। জীবনের স্বাদ নিয়ে যাব। বিদায়।”
সবাই অবাক হয়ে দেখল, জানালার গ্রিল ভেদ করে একটা গোল মৃদু আলোর ফোকাস এসে বিছানায় পড়েছে।
ধীরে ধীরে আলোটা ভোলানাথকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। যেন আলোর মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। আবছা হয়ে যাচ্ছে। নেই হয়ে যাচ্ছে।
মুকুন্দ রায় তার ভাগনে গোপাল গুছাইতের শরীর থেকে লাফ দিয়ে নেমে উত্তেজিত গলায় বলল, “এই হল সায়েন্স! একেই বলে বিজ্ঞান। দেখছেন তো যোগেনদা, সায়েন্স কাকে বলে! আমিও এই নলের মধ্যে ঢুকে পড়ছি। কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসে আচ্ছন্ন এই পৃথিবীতে আর নয়। ভোলানাথের সঙ্গেই আমি শতম গ্রহে চলে যাচ্ছি।”
বগলাপতিকে ছেড়ে যোগেন পালোয়ান ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, “আহা, নল দিয়ে যাওয়ার দরকারটা কী হে! এক লক্ষেই তো চলে যাওয়া যায়!”
মুকুন্দ নলের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে যেতে-যেতে বলল, “না,! আমি ওসব ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানায় বিশ্বাসী নই। আমি সায়েন্সে বিশ্বাসী। বিজ্ঞান আর যুক্তি ছাড়া বিশ্বে আর কিছু নেই।”
যোগেন বিরস মুখে বলল, “তা হলে এসে গিয়ে বাপু। দুনিয়ায় নাস্তিকের সংখ্যা যত কমে ততই মঙ্গল!”