“শুনেছি দুষ্প্রাপ্য ঘড়ির জন্য তিনি মানুষও খুন করতে পারেন।”
“আমিও শুনেছি আমাদের দেশে কয়েক হাজার বছর আগে যুদ্ধবিগ্রহ এবং খুনখারাপি হত। কিন্তু এখন তা ধুলোটে ইতিহাস। খুন তো দূরের কথা, কাউকে আঘাত করার কথাও কেউ ভাবতে পারে না। অস্ত্রশস্ত্র আমরা একমাত্র জাদুঘরে গেলে দেখতে পাই। তা ছাড়া অস্ত্র ব্যবহারের কোনও অবকাশ নেই। সেখানে কোনও অস্ত্র পাওয়াও যায় না। কিন্তু মৃগাঙ্কবাবু একটা অস্ত্র দিয়ে আমাকে ভয় দেখাচ্ছিলেন। আমি ভয় না পাওয়ায় উনি রেগে গিয়ে আমাকে ঘুসি মারেন। তাঁর লোকেরা আমার হাত থেকে ঘড়িটা জোর করে খুলে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এর স্ট্র্যাপটা একটা বিশেষ পদ্ধতি ছাড়া খোলে না। তারা চেষ্টা করেও পারেনি।”
“কিন্তু ভোলানাথ, প্রাণের চেয়ে তো আর ঘড়িটার দাম বেশি নয়। তুমি ঘড়িটা দিয়ে দিলেই পারতে!”
“পারতাম। কিন্তু সেটা ভয়ংকর অবিমৃশ্যকারিতা হয়ে যেত। এই ঘড়িটার ঠিকঠাক ব্যবহার না হলে পৃথিবীতে প্রলয় হয়ে যেতে পারত।”
“তার মানে?”
“এই ঘড়ি আকাশে হঠাৎ ঝড়ের মেঘের সঞ্চার ঘটাতে পারে, সমুদ্রে বিপুল তরঙ্গ তুলতে পারে, এর ভিতর থেকে বস্তুকণা ছুটে গিয়ে যে-কোনও ধাতু বা পাথরকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে পারে। এই জিনিস মৃগাঙ্কবাবুর হাতে পড়লে অঘটন ঘটতেই পারত।”
“তা বটে।”
“আরও একটা কথা আছে। এই ঘড়ি আমার কাছে না থাকলে দেশের লোকেরা আমার সন্ধান পাবে না। এই ঘড়ির সঙ্কেত ধরেই তারা একদিন আসবে।”
“এটা তাদের বুঝিয়ে বলেছ?”
“বলেছি! কেউ আমার কথা বুঝতে পারেনি। শুধু বেঁটে আর রোগা চেহারার একটা লোক একটু টের পেত। কিন্তু সে ভিতু মানুষ। বুঝেও আমাকে রক্ষা করতে পারেনি।”
“তোমার ঘড়িটার মধ্যে কি সত্যিই অত ক্ষমতা আছে?”
“দেখুন।” বলে ভোলানাথ তার বাঁ হাতটা তুলে ডান হাত দিয়ে ঘড়ির এক পাশে সামান্য চাপ দিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা তীব্র শিসের শব্দ তুলে কী একটা বস্তু ছুটে গিয়ে দরজার পাশের দেওয়ালটায় একটা প্রায় আধ ইঞ্চি ফুটো করে বেরিয়ে গেল।
“সর্বনাশ! এ তো সাংঘাতিক জিনিস!”
“এটা কিন্তু অস্ত্র নয়। আমাদের কাজের যন্ত্র হিসেবেই এর ব্যবহার।”
“তারপর?”
“দশ দিনের দিন মৃগাঙ্কবাবু ধৈর্য হারিয়ে আমাকে আক্রমণ করলেন। প্রথমটায় তাঁর দলবল আমাকে কিল-চড়-লাথি মারতে থাকে। আমি ভীষণ অবাক। মানুষের হাত-পা যে অন্যকে ব্যথা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা যায়, তা আমার জানাই ছিল না।”
“তাই তুমি উলটে মারতে পারনি?”
“না। তবে আমার প্রাণশক্তি সাংঘাতিক। অত মার খেয়েও ভেঙে পড়িনি।”
“তা আমি জানি। তোমার মতো জোরালো হার্ট আর লাংস আমি কখনও দেখিনি। তোমার মাল পাওয়ারও অবিশ্বাস্য। জলে বহুক্ষণ ডুবে থেকেও তোমার তেমন কিছুই হয়নি। প্রচণ্ড মার খেয়ে এবং পেটে গুলি লাগা সত্ত্বেও তোমার নাড়ি খুবই সবল স্বাভাবিক ছিল। তোমার ভাইটাল ফোর্স যে অসাধারণ তা আমি জানি। তুমি উলটে মারলে ওরা দাঁড়াতেই পারত না।”
“কী করব বলুন। আমি কখনও কাউকে মারিনি। কেউ আমাকে কখনও মারেনি। মারপিট ব্যাপারটাই আমাদের জানা নেই।”
“তারপর কী হল?”
“মার খেয়ে পালানোর জন্য আমি সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চলে যাই। তখন আমাকে কেউ গুলি করে। বাধ্য হয়ে আমি তিনতলার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়ি এবং অনেকটা দৌড়ে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিই।”
বিস্মিত করালী বললেন, “তিনতলার ছাদ থেকে লাফ! তোমার হাত পা ভাঙল না?”
“এখানে মাধ্যাকর্ষণ খানিকটা কম, আর আমার শরীর খুব নমনীয়। তাই তেমন লাগেনি। তবে ওরা উপর থেকে গুলি চালাচ্ছিল বলে আমার প্রাণের ভয় ছিল। ভাগ্য ভাল যে আমি ঘন্টায়
একশো মাইল বেগে দৌড়োতে পারি।”
“বাপ রে! তবে আমি অবিশ্বাস করতে পারছি না। তোমার পায়ের মাংসপেশির গড়ন ও নমনীয়তা আমি পরীক্ষা করেছি। তোমার কথা সত্যি হতে পারে।”
“মিথ্যে কথা ব্যাপারটা আমাদের মাথায় আসে না। আমাদের মস্তিষ্কের প্রোগ্রামিং-এর মধ্যে ওটা নেই।”
করালী দুঃখের সঙ্গে বললেন, “ঠিক কথা। হীন সমাজেই মিথ্যার প্রচলন আছে। উন্নত সমাজে মিথ্যা এক অপ্রয়োজনীয় আবর্জনা।”
এরপর কিছুক্ষণ ভোলানাথের শব্দতরঙ্গ শুনতে পেলেন না করালী। জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ?”
‘না, আমি আমার পৃথিবীতে এই আশ্চর্য জগতের কথা জানাচ্ছি। ভাল-খারাপ সত্যি-মিথ্যে, গরিব বড়লোক, টাকা-পয়সা, মারপিট, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কী অদ্ভুত এই গ্রহ। কিন্তু এখানে তীব্র উত্তেজনা আছে, বাঁচার ক্ষুধা আছে। আমাদের নিস্তরঙ্গ জীবনের মতো নয়। আমার কিন্তু খারাপ লাগছে না। বরং নিজের জগতে ফিরে যেতে হবে বলে মন ভার লাগছে।”
৯. বলি ওহে নাস্তিক
“বলি ওহে নাস্তিক! কাণ্ডটা দেখলে? কুলাঙ্গার, কুলাঙ্গার! এরাই অঘোরগঞ্জের নাম ডোবাবে দেখছি। শরীরচর্চা নেই, প্যাঁচপয়জার শিখল না, রিফ্লেক্স নেই, বুক ফুলিয়ে মস্তানি করে বেড়ায়। ছিঃ ছিঃ, দুটো গুন্ডা পাঁচজনকে পিটিয়ে পাট পাট করে দিয়ে গেল হে! দেখে আমার রক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে!”
“সবই স্বচক্ষে দেখলাম দাদা। বলতে দুঃখ হয় যে, গোপাল গুছাইত সম্পর্কে আমার ভাগনে।”
কথা হচ্ছিল গভীর রাতে। যোগেন পালোয়ান আর মুকুন্দ রায়ের মধ্যে। দু’জনেই ভারী লজ্জিত আর মনমরা।