“তুমি কি আমার কথা বুঝতে পার বাবা?”
“আমি আপনাদের ভাষা জানি না। কিন্তু সব স্পষ্ট বুঝতে পারি।”
“কী আশ্চর্য বাবা! আমি যে ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছি!”
“আপনি মনে-মনে কথা বললেও আমার বুঝতে কষ্ট হয় না।”
“আচ্ছা, তবে আমি মনে-মনেই বলি, তুমি কি এখন কিছু খাবে? “না, আমার খিদে পায়নি।”
“বাবা ভোলানাথ, তোমার বোধ হয় জ্বরবিকার মতো হয়েছে। ভুল বকচ্ছ।”
“ও কথা কেন বলছেন?”
“এই যে বললে তুমি আকাশের কোথা থেকে এসেছ! আকাশ থেকে আসবে কেন বাবা! ওকথা বলতে নেই। বরং গাঁয়ের নামটা মনে করার চেষ্টা করো।”
“আমার গায়ে কিন্তু জ্বর নেই।”
“তা বটে! গা তো এখন ঠান্ডা। তা হলে বোধ হয় মাথার চোটের জন্য কিছু মনে পড়ছে না। আমি বগলাপতি ঠাকুরপোকে খবর দিয়েছি। শুনেছি তাঁর মন্তরে ভাল কাজ হয়।”
“কিন্তু আমি তো ভাল হয়ে গিয়েছি। আপনি ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনুন। তিনি ঠিকই বুঝবেন।”
“অত চোট কি এক রাতে ভাল হয় বাবা? একটু সময় তো লাগবেই।”
“তা হলে আমিই ডাক্তারবাবুকে ডাকছি।”
সুরবালা খুব ধাঁধায় পড়ে গেলেন। টেলিপ্যাথি বলে একটা ব্যাপার আছে তিনি শুনেছেন বটে, কিন্তু সেটা যে এরকম আশ্চর্য কাণ্ড, তা তার জানা ছিল না। একটু পরেই করালীডাক্তার বাইরের ঘরে রুগি দেখা ছেড়ে শশব্যস্তে এসে ঘরে ঢুকে বললেন, “কী ব্যাপার বলো তো! আমার মনে হল, কে যেন এ ঘরে আমাকে ডাকছে।”
সুরবালা মুখ ব্যাজার করে বললেন, “ভুল শোনোনি। আজ সকাল থেকে ভুতুড়ে কাণ্ডটা হচ্ছে। ভোলানাথের মুখ থেকে একটা শব্দও বেরোচ্ছে না, কিন্তু কী করে যেন আমি ওর সব কথা শুনতে পাচ্ছি। আমার মনের কথাও ভোলানাথ শুনতে পাচ্ছে। হ্যাঁ গা, এসব কী হচ্ছে?”
একটু আগে ভোলানাথ ওরফে রা সুরবালাকে যা যা বলেছিল এবার করালীডাক্তারও সেই কথাগুলো শুনতে পেলেন, ‘আমার বাড়ি অনেক দূরে। আকাশের অন্য প্রান্তে। আমি যে পৃথিবীতে থাকি, সেখানে কেউ কথা বলে না…!’ করালীডাক্তার শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলেন, ভোলানাথের ঠোঁট নড়ছে না। আর কথাগুলো তিনি কান দিয়ে শুনছেন না, তার ভিতরে যেন কথাগুলো উচ্চারিত হচ্ছে।
করালীডাক্তার বিস্মিত হয়ে বললেন, “আমি তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি। এবং বিশ্বাস করছি। আমাকে সব খুলে বলল।”
“খুলে বললেও আপনি বুঝতে পারবেন না।”
করালীডাক্তার একটা চেয়ার নিয়ে ভোলানাথের মুখোমুখি বসে বললেন, “বুঝবার চেষ্টা করতে দোষ কী? অত দূর থেকে তুমি কীভাবে এলে? মহাকাশযানে নাকি?”
“মহাকাশযান সেকেলে জিনিস। আমি এসেছি নলের ভিতর দিয়ে।”
“নল? সেটা কী জিনিস?”
“টিউবুলার সিস্টেম অফ স্পেস ট্র্যাভেল।”
“টিউবটা কীসের তৈরি?”
“কী করে বোঝাব বলুন তো! ওই বিজ্ঞান তো আপনাদের জানা নেই। যদি বলি মনোরথ, তা হলে বুঝবেন?”
“মনোরথ তো কল্পনা।”
“সব কল্পনারই রূপ আছে। রূপায়ণও আছে।”
“ঠিক আছে। আবছাভাবে বুঝলাম। কিন্তু তুমি কী উদ্দেশ্যে এসেছিলে?”
“কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। একটা সবুজ প্রাণবান গ্রহ দেখে নেমে পড়েছিলাম।”
“তারপর?”
“বেচাকেনা কাকে বলে তা আপনি নিশ্চয়ই জানেন?”
“জানব না কেন?”
“আমি জানতাম না। আমি যেখানে থাকি সেই পৃথিবীতে বেচাকেনা বলে কিছু নেই। যার যখন যা প্রয়োজন তা সে পেয়ে যায়। এখানে টাকা-পয়সা বলেও একটা ব্যাপার আছে।”
“ভীষণভাবে আছে।”
“আমরা টাকা-পয়সার নামই শুনিনি।”
“কেনাকাটা না থাকলে টাকা-পয়সার প্রয়োজনই বা কী?”
“হ্যাঁ, ঠিক তাই। ফলে আমরা কেউ সঞ্চয় করি না। সোনাদানা আমাদের কাছে কোনও মূল্যবান জিনিস নয়। এক ধরনের ধাতু মাত্র, যা নানা কাজে লাগে। আমাদের দেশে গরিব বা বড়লোক বলেও কিছু হয় না। আপনার কি বিশ্বাস হচ্ছে?”
“হচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ বেচানোর কথা কেন?”
“আমি যেখানে এসে প্রথম নামি সেটা একটা বাগান। বেশ বড় দেওয়াল-ঘেরা বাগান। তাতে অনেক গাছপালা। তখন শেষ রাত্রি। আমি চারদিকে তাকিয়ে ভাল করে সব লক্ষ করছিলাম। হঠাৎ দুটো প্রকাণ্ড কুকুর গাঁক-গাঁক করে আমার দিকে তেড়ে এল। পিছন-পিছন ছুটে এল কয়েকজন পাহারাদার।”
‘কুকুরগুলো তোমাকে কামড়ায়নি তো!”
“কামড়েছিল। তবে আমার গায়ে একটা আবরণ থাকায় তারা দাঁত বসাতে পারেনি।”
“তারপর?”
“দরোয়ানরা আমাকে মৃগাঙ্কবাবুর কাছে নিয়ে যায়।”
“কোন মৃগাঙ্ক? ঘড়িয়াল মৃগাঙ্ক নাকি?”
“হ্যাঁ।”
“সর্বনাশ! সে যে ভীষণ খারাপ লোক!”
“খারাপ লোক কাকে বলে তা আমার জানা ছিল না। আমি এর আগে কোনও খারাপ লোক দেখিনি। তবে আমাদের দেশে কম মেধা এবং বেশি মেধার লোক আছে। খারাপ ভাল নেই।”
“বুঝেছি।”
“মৃগাঙ্কবাবু আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু আমার কথার তরঙ্গ তিনি ধরতে পারেননি। তিনি মনে করলেন আমি মূক এবং বধির।”
“সেটাই স্বাভাবিক।”
“তিনি আমাকে খুব আদরযত্ন করতে লাগলেন এবং বারবারই তিনি আমার ঘড়িটা দেখতে লাগলেন। দ্বিতীয় দিন তিনি আমাকে ঘড়িটার দাম জিজ্ঞেস করেন। দাম কাকে বলে তা জানা না থাকায় আমি তাকে কিছুই বলতে পারিনি। তিনি কয়েক বান্ডিল কাগজের টুকরো আমার কাছে নিয়ে এলেন।”
“হ্যাঁ, সেগুলোকে টাকা বলে।”
“হ্যাঁ, এখন আমি তা জানি। তিনি আমাকে একটা টাকাভর্তি মানিব্যাগ দিয়ে বললেন, “আমি যেন ইচ্ছেমতো কেনাকাটা করি। কিন্তু কেনাকাটা কাকে বলে সে ধারণাই আমার ছিল না। তৃতীয় দিন তিনি ঘড়িটার জন্য একটু জোরজুলুম করতে থাকেন।”