গোপাল ফুঁসে উঠে বলল, “তারা আমাকে খুব মারধর করেছে নাকি? তা হলে তাদের আমি এমন শিক্ষা দেব যে…!”
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “না মশাই, না। স্বচক্ষে দেখেছি, শচি আপনাকে মাত্র একটাই ঠোকনা মেরেছিল। আর তাইতেই–থাকগে, ওসব কথা আপনার শুনে আর কাজ নেই। বরং যা বলছি মন দিয়ে শুনুন। কথাটা হচ্ছে, বাবু বিশ্বাসকে নিয়ে।”
“কী কথা?”
“আমি যত দূর জানি, বাবু বিশ্বাস এ গাঁয়েই কারও বাড়িতে ঘাপটি মেরে আছে। কিন্তু তার বড় বিপদ। চিরু আর শচি তাকে খুঁজছে। তাদের উপর হুকুম আছে, বাবু বিশ্বাসকে দেখামাত্র খুন করে তার ঘড়িটা কেড়ে নিয়ে যেতে।”
“ঘড়ি! ঘড়ির জন্য কেউ খুন করে নাকি?”
“করে। মৃগাঙ্কবাবু করেন। নবিনগরে তার প্রাসাদোপম বাড়িতে যদি যান তা হলে ঘড়ি দেখে তাজ্জব হয়ে যাবেন। দুনিয়ায় হেন ঘড়ি তৈরি হয়নি যা তাঁর কালেকশনে নেই। গোল, চৌকো, তেকোনা, দু’কোনা, আটকোনা, অ্যানালগ, ডিজিটাল, অ্যানা-ডিজি-টেম্প, হিরে বসান, মুক্তো বসানো হাজার হাজার ঘড়ি। ওইটেই মৃগাঙ্কবাবুর শখ। ঘড়ির এমন নেশা তার যে, দুষ্প্রাপ্য ঘড়ি হাতানোর জন্য তিনি এ পর্যন্ত গোটা চারেক খুনও করিয়েছেন। আমাকে তিনি মাইনে দিয়ে রেখেছেন কেন জানেন?”
“কেন?”
আমার কাজ হল তাকে নানারকম ঘড়ির সুলুকসন্ধান দেওয়া এবং ঘড়ি হাতাতে সাহায্য করা। বাবু বিশ্বাসের ঘড়িটাই হয়েছে তার কাল।”
“কেন, বাবু বিশ্বাসের ঘড়িটা কীরকম? খুব দামি নাকি?”
“দামি হলে তো কথাই ছিল না। দাম দিতে ঘড়ি-পাগল মৃগাঙ্গবাবু এক কথায় রাজি। যেগুলো দাম দিয়ে পাওয়া যায় না সেগুলোই বাঁকা পথে আদায় করতে হয়। ঘড়ির জন্য তিনি পাহারাদার রাখেন, গুন্ডা পোষেন, গোয়েন্দা বহাল করেন। ঘড়ির জন্য টাকা খরচ করতে তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই। বাবু বিশ্বাসের ঘড়িটার জন্য তিনি কত কবুল করেছিলেন জানেন? পঞ্চাশ লাখ টাকা!”
শুনে হা হয়ে গেল গোপাল। কিছুক্ষণ মুখে বাক্য সরল না। তারপর অবিশ্বাসের গলায় বলল, “পঞ্চাশ লাখেও দিল না? লোকটা তো বুরবক দেখছি!”
“দেওয়ার উপায় নেই মশাই। ঘড়ি দিলে বাবু বিশ্বাস বাড়ি ফিরবে কী করে?”
“তার মানে? ঘড়ির সঙ্গে বাড়ি ফেরার সম্পর্ক কী?”
“আছে মশাই আছে। ওই ঘড়ির সংকেত ধরেই তো তার বাড়ির লোক তাকে নিতে আসবে।”
‘দুর মশাই! আপনি আমার মাথাটা ফের গুলিয়ে দিচ্ছেন।”
“মাথা গুলিয়ে যাওয়ারই কথা। আমারও গুলিয়ে গিয়েছিল কিনা!”
“সে তো আর কচি খোকা নয় যে, বাড়ির লোক নিতে না এলে যে বাড়ি ফিরতে পারবে না!”
“ভুল করছেন মশাই। মনে রাখবেন, বাবু বিশ্বাসের বাড়ি আকাশে। সে যে আকাশ থেকে খসে পড়েছিল সেটা কি ভুলে গেলেন?”
“শুনে আমারও তো আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা। একটু খোলসা করে বলবেন ব্যাপারটা আসলে কী? আকাশে কি কারও বাড়ি থাকতে পারে মশাই?”
“যা শুনেছি তাই বলছি।”
“কার কাছে শুনেছেন? বাবু বিশ্বাসের কাছে তো! সে গুল মেরেছে।”
লোকটা চোখ বড় বড় করে ভারী অবাক হয়ে বলল, “গুল মারবে কী মশাই, সে তো মোটে কথাই বলতে পারে না।”
“মূক নাকি?”
“মৃগাঙ্কবাবু ডাক্তার ডাকিয়ে দেখিয়েছিলেন। ডাক্তার বলেছে, মূকও নয়, বধিরও নয়।”
“তা হলে কথা কয় না কেন?”
“এই তো সমস্যায় ফেলে দিলেন। বাবু বিশ্বাস কথা কয় না বটে, কিন্তু তার সামনে বসে যদি শান্ত মনে তার দিকে চেয়ে থাকেন, তা হলে অনেক কিছু টের পাবেন। তা কথার চেয়ে কিছু কম নয়।”
“আচ্ছা, সে যদি কথাই না কইবে তা হলে সে যে বাবু বিশ্বাস তা জানলেন কী করে?”
লোকটা একগাল হেসে বলল, “জানি না তো! ওটাও ছদ্মনাম। আসলে কাজ-চলা গোছের একটা নাম দেওয়ার দরকার হয়েছিল বলে মৃগাঙ্কবাবুই ওর নাম দেন বাবু বিশ্বাস। কিন্তু মশাই, আর দেরি করা কি ঠিক হবে? ভোর হয়ে আসছে। এতক্ষণে যদি খুনটা না হয়ে থাকে তবে আর দেরিও নেই। বাবু বিশ্বাসকে এখনই খুঁজে বের না করলেই নয়। সেটা চিরু আর শচির আগেই।”
গোপাল লাফিয়ে উঠে বলল, “চলুন তো, দেখি তাদের এলেম!”
৮. ঠাকুরঘরে বসে সুরবালা
ঠাকুরঘরে বসে সুরবালা ফল কাটছিলেন, হঠাৎ শুনতে পেলেন কে যেন ডাকল, “মা!”
সুরবালা চমকে উঠলেন, তার কোনও সন্তান নেই। মা বলে কেউ ডাকে না তো! তবে ভিখিরিটিকিরি বা কাজের মেয়েটেয়ে, এরা ডাকে। কিন্তু সে ডাক এরকম নয়। এ ডাকটা অন্যরকম। ভাবলেন ভুল শুনেছেন, কিংবা পাশের বাড়ির শব্দও হতে পারে।
কিছুক্ষণ পরে আবার স্পষ্ট মনে হল, কেউ ডাকছে, “মা।” এবার অবাক হয়ে বুঝতে পারলেন, শব্দটা তিনি কানে শোনেননি। ডাকটা তার ভিতরেই যেন সৃষ্টি হল! আশ্চর্য ব্যাপার তো! বাইরে থেকে কেউ ডাকছে না, কিন্তু ভিতরে ডাক তৈরি হচ্ছে, এ কেমন কথা! এরকম কি হয়? না মনের ভুল!
এবার স্পষ্ট টের পেলেন তার ভিতরে একটি ছেলের গলা বলে উঠল, “মা, আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন, আমি জানি। অবাক হবেন না।”
সুরবালা হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “তুমি কে বাবা? আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“আমি রা।”
“রা!কী আশ্চর্য নাম। কিন্তু তুমি কোথা থেকে কথা বলছ বাবা?”
“আপনি আমার নাম দিয়েছেন ভোলানাথ।”
“ওঃ! তুমি ভোলানাথ! আমি এক্ষুনি তোমার কাছে আসছি বাবা! এক্ষুনি।”
সুরবালা আলুথালু হয়ে ছুটে এসে দেখলেন, ছেলেটা তেমনি শান্তভাবে শুয়ে আছে। চোখের দৃষ্টিও ভারী ঠান্ডা। মুখে প্রশান্তি। তার ঠোঁট নড়ছে না। তবু সুরবালা তাঁর নিজের ভিতরেই কথার শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। ভোলানাথ বলছে, “আমার বাড়ি অনেক দূরে। আকাশের অন্য প্রান্তে। আমি যে পৃথিবীতে থাকি সেখানে কেউ কথা বলে না, আমাদের কোনও ভাষা নেই, শব্দ নেই। কিন্তু আমরা আমাদের কথার তরঙ্গ অন্যের কাছে পাঠাতে পারি। অন্যের তরঙ্গও বুঝতে পারি। অনেক দূরের লোকের সঙ্গেও আমরা এইভাবে কথা কই। কোনও ভাষার দরকার হয় না।”