“দাঁড়া, দাঁড়া! একটা খাস ফেলার মতো শব্দ হল যেন! গলার কাছটা দ্যাখ তো, শিরা দপদপ করছে কি না?”
বিপদভঞ্জন দেখে বলল, “মনে হল একটু যেন কাঁপছে মাঝে মাঝে। তবে মনের ভুলও হতে পারে। করালীডাক্তারকে একটা
খবর দিতে পারলে হত!”
“করালীডাক্তার আসবে কেন? কী দায় পড়েছে?”
দূরে মাঠের মধ্যে একটা লোক ইট দিয়ে গোরুর খোঁটা পুঁতছিল। সে এবার এগিয়ে এল। পরনে হেঁটো ধুতি, খালি গা, কালো, রোগা, মাঝবয়সি একটা লোক। খানিকক্ষণ কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কাণ্ডটা দেখে হঠাৎ বিজ্ঞের মতো বলল, “ওরে বাপু, খুনখারাবি করার একটা রীতি আছে তো! এই ভরদুপুরে, লোকালয়ে পাঁচটা লোকের চোখের সামনে ওরকমভাবে মানুষ মারতে হয়?”
শঙ্কাহরণ আর বিপদভঞ্জন ভড়কে গিয়ে বলল, “কে বলল খুনখারাবি করছি?”
“আহা, ওসব কি বলতে হয়? কবুল করার মতো আহাম্মক তো আর তোমরা নও! তা কত পেলেটেলে? মোটা দাও মেরেছ তো?”
বিপদভঞ্জন বিরক্ত হয়ে বলল, “শুনলি তো শঙ্কু? কী বলেছিলাম? এই তো ফ্যাসাদ বাধল!”
শঙ্কাহরণ বলল, “কীসের খুনখারাবি মশাই? জলে ডোবা একটা লোককে রক্ষে করার চেষ্টা করছি।”
“তাই বলল! জলে ডুবিয়ে মেরেছ! তা মেরেই যখন ফেলেছ তখন আর কী করা। তবে কিনা এই চৈতন্যপুর জায়গা কিন্তু খুব খারাপ। লোকে টের পেলে প্রাণ হাতে করে বেরোতে পারবে না।”
শঙ্কাহরণ বিরক্ত হয়ে বলল, “কী মুশকিল! এটা মোটেই খুনখারাবির ব্যাপার নয় মশাই। যান তো, নিজের কাজে যান?”
লোকটা বড় বড় দাঁত দেখিয়ে মিচকে একটা হাসি হেসে বলল, “যেতে বলছ! তা না হয় গেলাম। কিন্তু বন্দোবস্তটা কীরকম হবে?”
“বন্দোবস্ত! কীসের বন্দোবস্ত মশাই?”
“বুঝলে না! আমার মুখ যদি না খোলাতে চাও, তা হলে একটি হাজার টাকা হাতে গুঁজে দাও, তারপর যা খুশি করো। এ মুখে একদম কুলুপ এঁটে যাবে।”
“আমাদের মাথায় অত বুদ্ধি নেই মশাই যে, প্যাঁচের কথা বুঝব। আমাদের ট্র্যাকে মালকড়ি নেই, আমরা হাভাতে লোক।”
“আহা, তোমাদের না থাক, মরা লোকটার পকেটে তো একটা মানিব্যাগ উঁচু হয়ে আছে দেখছি। হাতে দু-দুটো আংটি, গলায় সোনার চেন! তা সব মিলিয়ে দশ-বিশ হাজার মেরেছ ভায়া। হাজার টাকা কি বেশি হল? খুনের কেস বলে কথা!”
শঙ্কা আর বিপদ এতক্ষণ আংটি আর চেন লক্ষ করেনি। এবার করল। বিপদভঞ্জন মুখ শুকনো করে বলল, “কী হবে রে শঙ্কু?”
দু’জনের মধ্যে শঙ্কাহরণের একটু সাহসটাহস আছে। বুদ্ধিও ছিল এক সময়। ছেলেবেলায় মাথায় অনেক বুদ্ধির ঝিকিমিকি খেলত, ফন্দিফিকির আসত। কিন্তু চর্চার অভাবে এখন মাথাটা কেমন বোঁদা মেরে গেছে। সারাদিন খিদের চিন্তা করলে মানুষের মগজ পেটে নেমে বসে থাকে। আজ বুদ্ধিটাকে সে চাগিয়ে ভোলার চেষ্টা করতে-করতে নিপাট ভালমানুষের মতো মুখ করে বলল, “আপনাকে হাজারটা টাকা দেওয়া তেমন শক্ত নয় বটে! তবে কথা কী জানেন, অন্যের টাকা দান-খয়রাত করাটা তো ন্যায্য কাজ নয়। কেমন কিনা বৃন্দাবনদাদা?”
লোকটা খ্যাক করে উঠল, “বৃন্দাবনদাদা! বৃন্দাবনদাদাটা আবার কে?”
“চৈতন্যপুরের বৃন্দাবনদাদাকে কে না চেনে? প্রাতঃস্মরণীয় মানুষ আপনি!”
“কথা ঘোরাবার চেষ্টা কোরো না বাপু! বৃন্দাবনটন কেউ এখানে নেই। আমি হলুম কামাখ্যাচরণ দাস। এ গাঁয়ে চোদ্দো পুরুষ ধরে বসবাস। সবাই একডাকে চেনে। তা ও কথাটা কী বললে, অন্যের টাকা না কী যেন! ওরে বাপু, মানুষ পটল তুললে আর তার কিছু থাকে? তার টাকা তখন আর পাঁচজনেই লুটেপুটে খায়।”
শঙ্কাহরণ ভারী কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “পটলতোলা বাবুর কথা হচ্ছে না মশাই। হচ্ছে বাটু পরিহারমশাইয়ের কথা। পরিহারমশাই যদি শোনেন যে, তাঁর হক্কের টাকা থেকে আপনাকে ভাগ দিতে হয়েছে, তা হলে কি আমাদের হাড়গোড় আস্ত রাখবেন?”
লোকটা ভড়কে গিয়ে বলল, “পরিহারের কথা উঠছে কেন?”
“উঠবেই তো! আমরা তাঁর দলেরই লোক কিনা!”
লোকটা একটু হাঁ করে থেকে বলল, “বাটু পরিহারের লোক! সে কথা আগে বলবে তো!”
“গুহ্য কথা পাঁচজনকে বলে বেড়ানো কি ভাল? আপনার চাপাচাপিতে বলে ফেলতে হল!”
“তা বাপু, পরিহারমশাইকে আমার নমস্কার জানিয়ে। যা করছ। করো, কেউ কিছু বলবে না।”
লোকটা তাড়াতাড়ি হাঁটা দিয়ে কয়েক পা গিয়ে ফের ফিরে এল। ভারী অমায়িক গলায় বলল, “বুঝলে বাপু, বুড়ো হয়েছি তো, ভীমরতিই হবে! এখন মনে পড়েছে, আমার নামটা বৃন্দাবন ঘোষই বটে! দিদিমা রেখেছিলেন। বুঝলে তো! ওই বৃন্দাবন ঘোষই থাকুক, কেমন?”
“যে আজ্ঞে। যা বলবেন!”
কামাখ্যা বা বৃন্দাবন হনহন করে হেঁটে লহমায় মাঠ পার হয়ে গেলে বিপদভঞ্জন বলল, “বাটু পরিহারটা আবার কে রে?”
“সে আছে। সব জায়গাতেই একটা করে মানুষ-মুষল থাকে। ছিনতাই করে, খুনখারাবি করে, তোলা নেয়, মাথা ফাটায়, ঠ্যাং ভাঙে। এ তল্লাটের মুষল হল বাটু পরিহার। আমাদের আঘোরগঞ্জে যেমন গোপাল গুচ্ছাইত। শীতলাবাজারে তেমন ল্যাংড়া সানাই, আবার রাধিকাপুরে হল ন্যাড়া শিবু।”
বিপদভঞ্জন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ওরকম একটা কিছু হতে পারলেও বেশ হত!”
“মাংসের মশলা কি আর সুক্তোয় খাটে! আমরা ওরকম হতে গেলে হিতে বিপরীত হবে!”
“এখন এ লোকটাকে নিয়ে কী করা?”
“দেখা যাক আর-একটু চেষ্টা করে। জ্ঞান না ফিরলে জলেই ফেলে দিতে হবে।”