“বলেন কী?”
“তা হবে না? যখন রাজপুত্র সাজি তখন এক নাম, যখন কাবুলিওলা সাজি তখন আর-এক নাম, যখন পুলিশ সাজতে হয় তখন ভিন্ন নাম, যখন কুলিকামারি বা রিকশাওলা সাজতে হয়, তখন ফের নতুন নাম। আর এই করতে গিয়েই তো সর্বনাশটা হল। চৌষট্টিটা নামের মধ্যে আমার আসল নামটাই গেল গুলিয়ে। এখন মাথায় ডাঙস মারলেও পিতৃদত্ত নামটা মনে পড়ে না মশাই।”
“বটে! কিন্তু ছদ্মবেশ ধরেন কেন?”
“না ধরে উপায় আছে? আমার বড় বিপদের কাজ মশাই। আমি হলুম গোয়েন্দা পোয়াবারো।”
“পোয়াবারো? কথাটা যেন কোথায় শুনেছি!”
“তা শুনে থাকবেন, তবে এটাও ছদ্মনাম।”
“আপনি তা হলে পুলিশের লোক?”
“কস্মিনকালেও নয়। পুলিশে ঢোকার বড় সাধ ছিল মশাই, সাইজের জন্য হল না। আমি প্রাইভেট গোয়েন্দা।”
গোপাল খুব কষ্টে উঠে বসল, তারপর খানিকক্ষণ ঘাড় নেড়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে মাথার ধোঁয়াশা কাটানোর চেষ্টা করে বলল, “কিন্তু আমিই বা এখানে পড়ে আছি কেন, আর আপনিই বা এখানে বসে আছেন কেন?”
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “মরে থাকার চেয়ে পড়ে থাকা কি ঢের ভাল নয়?”
“ও কথা বলছেন কেন?”
“ঠিকই বলছি। চিরু আর শচির পাল্লায় পড়লে প্রাণ নিয়ে কম লোকই ফেরে।”
“তারা কারা?”
“তারা খুব মারকুট্টে লোক মশাই। পেশাদার খুনি৷”
“তারা কি আপনাকে মেরেছে?”
“আপনাকেও কি ছেড়েছে নাকি?”
গোপাল ভারী অবাক হয়ে বলল, “আমাকেও মেরেছে?”
“তবে! মেরে নাম ভুলিয়ে দিয়েছে।”
“এ তো ভারী অন্যায়!”
“অন্যায়! তা অন্যায় হলেও সব জিনিসেরই একটা ভাল দিকও তো আছে। আপনারা দলবল নিয়ে এসে চড়াও হওয়াতেই তো আমার প্রাণটা এ যাত্রা বেঁচে গেল! আর আপনাদের সুবিধের দিকটাও বিবেচনা করুন। অনেকজন থাকায় চিরু আর শচি কারও উপরেই সুবিচার করতে পারল না, মারটা ভাগাভাগি হয়ে গেল। আর এ তো সবাই জানে যে, কোনও জিনিস ভাগাভাগি হলে পরিমাণে কমে যায়।”
গোপাল সচকিত হয়ে বলল, “আমার দলবলও ছিল নাকি? তা তারা সব গেল কোথায় বলুন তো!”
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “সকলের কথা জানি না। একজনকে দেখেছি শচির রদ্দা খেয়ে ভুল বকতে বকতে ওই মাঠধরে বোধ হয় বিবাগীই হয়ে গেল। আর-একজনকে চিরু হাঁটু দিয়ে মেরুদণ্ডে মারায় সে ভেউ-ভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে ওই ইটের পাঁজার পিছনে গিয়ে লটকে পড়েছে। একজন শচির চড় খেয়ে হঠাৎ গৌরাঙ্গের মতো দু’হাত তুলে মা, মা বলে ডাকতে-ডাকতে মাকে খুঁজতে যে কোথায় চলে গেল কে জানে। চার নম্বর ছোঁকরা চড়চাপড় খেয়ে সেই যে দৌড়ে গিয়ে ওই ঝুপসি গাছটায় উঠে পড়েছিল আর নামেনি।”
“কিন্তু এসব হচ্ছে কেন মশাই?” ৮০
“হচ্ছে বাবু বিশ্বাসের জন্য।”
“বাবু বিশ্বাসটা কে?”
লোকটা ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলল, “বললে বিশ্বাস হবে না। তবে সে একজন খসে পড়া মানুষ।”
“খসে পড়া মানুষ আবার কী মশাই?”
“শুনেছি, সে নাকি আকাশ থেকে খসে পড়েছিল।”
“আকাশে কি মানুষের গাছ আছে যে, খসে পড়বে?”
লোকটা উদাস গলায় বলল, “দুনিয়ায় কত কী হয়!”
গোপাল গুছাইত কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কিছুই তেমন পরিষ্কার হল না তার কাছে। এমনকী সে প্রাণনাথ না হরিপদ ঘোষ, সেটাও সাব্যস্ত হল না এখনও। তার মধ্যে এই পোয়াবারো, হিরু, শচি, বাবু বিশ্বাসরা ঢুকে মাথাটা আরও গণ্ডগোল করে দিচ্ছে।
গোপাল করুণ গলায় বলল, “না হয় ধরেই নিলাম, বাবু বিশ্বাস আকাশ থেকেই পড়েছে, কিন্তু সে পড়ার ফলে হলটা কী?”
পোয়াবারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সে পড়ার পরই যে কালবোশেখির ঝড় শুরু হয়ে গেল!”
“কালবোশেখির ঝড়! কালবোশেখির ঝড়!” বিড়বিড় করতে করতে হঠাৎ যেন মাথায় উপর্যুপরি বজ্রাঘাত হতে লাগল গোপালের। তাই তো! বৈশাখী ঝড়! কাল রাতে সে তো দলবল নিয়ে হেতমপুরের ‘বৈশাখী ঝড়’ যাত্রা দেখতে গিয়েছিল! সে তো মোটেই প্রাণনাথ সেন বা হরিপদ ঘোষ নয়! সে যে অঘোরগঞ্জের অবিসংবাদী রুস্তম, এক এবং অদ্বিতীয় রবিন হুড গোপাল গুছাইত!
গোপাল হঠাৎ লাফিয়ে উঠে গর্জন ছাড়ল, “আমি গোপাল! আমি যে গোপাল গুছাইত!”
পোয়াবারো বিরক্ত হয়ে বলল, “আহা, আবার নাম বাড়াচ্ছেন কেন? দুটো নাম নিয়েই দোটানায় পড়েছেন, আর-একটা নাম জুটলে যে হিমশিম খাবেন!”
গোপাল হুংকার দিয়ে উঠল, “কে বলল আমার তিনটে নাম? আমার একটাই নাম। গোপাল গুছাইত। এ নাম শুনলে অঘোরগঞ্জে সবাই কঁপে।”
লোকটা চোখ পিটপিট করে বলল, “অ! তা হলে আপনি সত্যিই গোপাল গুছাইত! ভাগ্যবান লোক মশাই আপনি! আর আমার অবস্থা দেখুন। নকল দাড়ি-গোঁফ, নকল চুল, নকল পোশাক আর নকল নামের জঙ্গলে হারিয়ে বসে আছি। আমি যে আসলে কে তা আর আমিও বুঝতে পারি না।”
গোপাল ফুসতে-ফুসতে বাঘা গলায় ধমক দিয়ে বলল, “বকোয়াস বন্ধ করো। কে বা কারা আমার আর আমার স্যাঙাতদের গায়ে হাত তুলেছে? কার এত সাহস? কোথায় চিরু আর শচি?”
পোয়াবারো মোলায়েম গলায় বলল, “হবে-হবে। ঠান্ডা হয়ে বসুন তো! সব সময় হাঁকডাক আর গায়ের জোরে কাজ হয় না। তাতে বরং কাজ ফসকে যায়।”
গোপাল কিছুক্ষণ ফোঁসফোঁস করে তারপর ধপ করে বসে পড়ল। বলল, “রাগে যে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে!”
“তা জ্বলতেই পারে। আপনি একজন পালোয়ান লোক, পালোয়ানরা মারধর খেতে একদম পছন্দ করে না।”