মুকুন্দ রায় গম্ভীর গলায় বলল, “আমি বৈধব্যের ঘোর বিরোধী। তবু যদি কেউ সাধ করে বিধবা হয়, আমি কী করতে পারি? আর শ্রাদ্ধ-শান্তি তো কুসংস্কার, অনর্থক পয়সার অপচয়, পুরোহিততন্ত্রের হাত শক্ত করা। ওসব আগডুম বাগড়ম বকে কোনও লাভ নেই। ওই চিটিংবাজটা তোর মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে।”
লালমোহনবাবু আর উচ্চবাচ্য করতে সাহস পেলেন না। ধুতির খুঁট দিয়ে বগলাপতির মাথায় হাওয়া দিতে দিতে শুধু বললেন, “যে আজ্ঞে। তবে কিনা, সব জিনিসেরই তো একটা নিয়ম আছে দাদা। মরার পরেও জ্যান্ত থাকাটা কি ভাল দেখায়?”
মুকুন্দ রায় চোখ পাকিয়ে বলল, “চোপ রও বেয়াদব! আমাকে বাঁচা-মরা শেখাতে এসেছে!”
ক্রুদ্ধ, উত্তেজিত এবং বিক্ষুব্ধ মুকুন্দ রায় লাফ মেরে বটগাছের একখানা খুব উঁচু ডালে উঠে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুয়ে পড়ল, “নাঃ, এ দেশটার কিচ্ছু হবে না। কোথায় গেল এদের যুক্তিবোধ, কোথায় গেল বিজ্ঞানমনস্কতা, কোথায় গেল কমন সেন্স! রাজ্যের কুসংস্কার, অজ্ঞানতা আর অন্ধ বিশ্বসে ডুবে আছে সব। বলে কিনা ভূত! কোথায় যে ভূত, কীসের যে ভূত, সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না!”
.
পরদিন সকালে বগলাপতি কাহিল মুখে বাইরের ঘরে সাধনচৌকিতে বসে ছিলেন। মুখচোখে থমথমে ভাব, চোখে এখনও আতঙ্ক। কাল রাতে জ্ঞান ফিরে আসার পর লালমোহনের কাঁধে ভর দিয়ে টলতে টলতে বাড়ি ফিরেছেন। সারা রাত আতঙ্কে ভাল করে ঘুম হয়নি। সকালে কোষ্ঠ পরিষ্কার হয়নি, খাওয়ায় রুচি নেই, পুজোপাঠটাও ভাল করে করা হয়নি, বসে বসে আকাশ-পাতাল ভাবছেন।
এমন সময় দুটি লোক এসে গুটিগুটি সামনে দাঁড়াল। মুখে গ্যালগ্যালে হাসি। হাত কচলাতে কচলাতে বলল, “বগলাঠাকুর, একবার ডাক্তারবাবুর বাড়িতে যেতে হবে যে! গিন্নিমা খবর পাঠিয়েছেন।”
“কেন রে?”
“আজ্ঞে, ঝাড়ফুঁকের ব্যাপার আছে!”
বগলাপতি সবেগে মাথা নেড়ে বলে উঠলেন, “ওরে না, না। বুজরুকি আমি ছেড়ে দিয়েছি। ও পথে আর নয়। যা জমিজমা আছে তাইতেই চাষবাস করে চালিয়ে নেব। ওসব ঝাড়ফুক-টাড়ফুক স্রেফ চিটিংবাজি। ওসব ছেড়ে দিয়েছি রে!”
লোকটা ভারী অবাক হয়ে বলল, “আজ্ঞে, আপনি ওসব ছেড়ে দিলে আমাদের চলবে কীসে? বুজরুকি ছাড়া কি আমাদের চলে?”
বগলাপতি মাথা নাড়া থামাননি। সেটাই চালিয়ে যেতে-যেতে বললেন, “না রে, না, ওসব আর আমাকে বলিসনি। আমার খুব শিক্ষা হয়ে গেছে। ও সবের মধ্যে আমি আর নেই।”
“কিন্তু বগলাঠাকুর, বুজরুকিতে যে মাঝে-মাঝে কাজ হয়। আপনার ঝাড়ফুক, জলপড়ায় বেশির ভাগ রুগিই ভাল হয় না বটে, কিন্তু মাঝেমধ্যে এক-আধটা তো দিব্যি গাঝাড়া দিয়ে উঠেও পড়ে!”
“হ্যাঁ রে, তোরা তৃতীয় নয়ন বুঝিস?”
“আজ্ঞে, তিন নম্বর চোখ তো!”
“হ্যাঁ। আমার তৃতীয় নয়ন খুলে গেছে রে। সারা জীবন যত অপকর্ম করেছি, সব দেখতে পাচ্ছি। তোরা যা বাপু, আমাকে এখন একা-একা বসে ভাবতে দে। আমি রোগটোগ সারাতে পারি না, আমার কোনও পোষা ভূত নেই, আমি মারণ-উচাটন বশীকরণ জানি না। এত দিন ভাঁওতাবাজি করে লোক ঠকিয়ে খেয়েছি। এখন প্রায়শ্চিত্ত করব।”
.
“সে আর নতুন কথা কী? আপনি যে ভাওতাবাজ, ভণ্ড, চিটিংবাজ, এ তো সবাই জানে। হাটে বাজারে বলাবলিও হয়। তা বলে কি বিপদে পড়লে লোকে আপনার কাছে এসে ধরনা দেয় না? আপনি জালি, দু’নম্বরি হলেও বিপদেআপদে লোকে তো আপনার উপরেই ভরসা করে, নাকি? সেটা কি কিছু কম কথা?”
হাপুস নয়নে, মুখে হতাশার ছাই মেখে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন বগলাপতি। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধরা গলায় বললেন, “লোকে ওসব বলে বুঝি! বেশ করে, এবার থেকে আমিও সবাইকে বলে বেড়াব যে, বগলাপতি একটা ভন্ড, চিটিংবাজ, জোচ্চোর, ভাওতাবাজ… আর কী বাকি রইল রে?”
“আজ্ঞে, ওতেই হবে। কিন্তু এবার যে গা না তুললেই নয়, বগলাঠাকুর। গিন্নিমা যে আপনার আশায় বসে আছেন।”
“কার বাড়ি যাওয়ার কথা বললি যেন?”
“আজ্ঞে, আমাদের নমস্য করালীডাক্তার।”
বগলাপতি আঁতকে উঠে বললেন, “সর্বনাশ! তার চেয়ে কেউটে সাপের গর্তে হাত ঢোকাতে বল, খ্যাপা ষাঁড়ের সামনে লাল জামা পরে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে বল, বাঘের দুধ দুইয়ে আনতে বল, রাজি আছি। তবু করালীডাক্তারের চৌকাঠ ডিঙোতে পারব না রে বাপু।”
শঙ্কাহরণ গলা নামিয়ে বলল, “একটু ভেবে দেখুন কর্তা, বুজরুকি তো আর বারবার ফেল হতে পারে না। দশবারের মধ্যে হয়তো একবারই লেগে গেল। যদি লেগেই যায় তা হলে করালীকর্তাও আপনাকে দোবেলা সেলাম ঠুকবেন।”
বিপদভঞ্জন পাশ থেকে বলল, “করালীকর্তার আপনার উপর ভরসা নেই বটে, কিন্তু মা ঠাকরোনের আছে। তিনি বলেছেন, বগলাঠাকুরপো ছাড়া ওই ছোঁকরার ব্যায়ো কেউ সারাতে পারবে না। ওষুধের কর্ম নয় মশাই। ভাল তেজিয়ান মন্তর ঝাড়লে কাজ হতে পারে। আর কাজ যদি হয় তা হলে চাই কী? মা ঠাকরোন হয়তো আপনার কালীমন্দির বাবদ হাজার পাঁচেক টাকাই ফেলে দেবেন।”
“প্রাণ বড় না পাঁচ হাজার টাকা বড় রে?”
শঙ্কাহরণ ঘাড় চুলকে বলল, “এই তো ধন্দে ফেলে দিলেন। যদি সত্যি কথা বলতে হয় তো বলি, প্রাণের আর দাম কী? হালকাপলকা ফঙ্গবেনে জিনিস, হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। তার চেয়ে পাঁচ হাজারের পাল্লা ঢের ভারী।”
বগলাপতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তোরা একটা ছোঁকরার কথা বললি যেন!”