“এবার ভায়া? চিরকাল তো ভূত নেই, ভগবান নেই বলে বুক বাজিয়ে তর্ক করে গেলে! এবার বিশ্বাস হল তো!”
“কী বিশ্বাস হবে?”
“কেন, ভূত!”
“কেন, ভূতে বিশ্বাস করতে যাব কেন? আমার কি ভীমরতি হয়েছে?”
নিশাপতি চোখ কপালে তুলে বলল, “বলো কী হে! এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না? এই যে আমি ভূত, এই যে তুমি ভূত, টের পাচ্ছ না। নাকি?”
মুকুন্দ রায় গরম হয়ে বলল, “যুক্তি আর বিজ্ঞান ছাড়া আমি কিছু বিশ্বাস করি না জানোই তো!”
“আমরা যে ভূত, এটা তো মানবে! নইলে মরার পরও আমরা আছি কী করে?”
“সেটা ভাবতে হবে। এটা হয়তো ভুল দেখা এবং ভুল বোঝার ব্যাপার। ভূতটুত কিছু নেই হে। ওসব কুসংস্কার!”
নিশাপতি গিয়ে জনাদশেক ভূতকে ডেকে আনল। তাদের মধ্যে লতা, যোগেন পালোয়ান, বাচস্পতিমশাই, নন্দদুলাল হাতি, বিস্তর চেনামুখ। সবাই নানাভাবে মুকুন্দকে বোঝানোর চেষ্টা করল যে, মুকুন্দ হেরে গিয়েছে এবং এবার তার ভূতে বিশ্বাস করা উচিত। মুকুন্দ সমান তেজে সকলের সঙ্গে লড়ে গেল এবং বিস্তর বিখ্যাত মানুষের কোটেশন ঝেড়ে প্রায় প্রমাণ করেই ছাড়ল যে, ভূত বলে কিছু থাকতেই পারে না, ওটা অন্ধ বিশ্বাস ছাড়া কিছু নয়।
সেই থেকে মুকুন্দ একটু একা হয়ে আছে। কারও সঙ্গে বিশেষ মেশেটেসে না। বসে বসে কেবল ভাবে, কখনও একটুআধটু পায়চারি করে।
কাল রাতে বগলাপতির মনটা ভারী প্রসন্ন ছিল। হবে না-ই বা কেন। পকেটে নগদ কড়কড়ে হাজার টাকা। তিনি বাড়িমুখো হাঁটতে হাঁটতে লালমোহনবাবুকে জীবনের অনিত্যতার কথা বোঝাচ্ছিলেন। বলছিলেন, “বুঝলে লালুভায়া, গীতায় আছে, বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়, মানে তো নিশ্চয়ই জানো, মরার পর বাসি ছেঁড়া কাপড় ফেলে দিতে হয়।”
লালমোহনবাবু ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললেন, “সেটা কি ঠিক হবে বগলাদা? ছেঁড়া কাপড় দিয়ে তো আমার গিন্নি দিব্যি কাঁথা সেলাই করেন, পিদিমের সলতে পাকান, ঘর মোছার ন্যাতা করেন। তারপর ধরুন, পাঁচখানা পুরনো কাপড়ের বদলে ফিরিওলার কাছে একখানা বড় স্টিলের বাটি পাওয়া যায়।”
“বলো কী? আমার গিন্নি তো ভারী বোকা দেখছি! তিনি তো সেদিন সাতখানা পুরনো কাপড় দিয়ে স্টিলের বাটি নিয়েছেন।”
“তাই তো বলছি, বইয়ে-কেতাবে ভাল-ভাল কথা লেখা থাকে বটে, কিন্তু ওসব ধরতে নেই। তারপর ধরুন, মরার পরও কি জামাকাপড় লাগে না? নইলে লজ্জা নিবারণ হবে কী করে বলুন!”
“না হে, মরার পর আর জামাকাপড়ের বালাই নেই। বায়ুভূত অবস্থা তো, জামাকাপড় পরার উপায়ও থাকে না কিনা!”
লালমোহনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “কথাটা ঠিক হল না দাদা। এই তো গত মঙ্গলবার ভরসন্ধেবেলা নদীর ধারে বাচস্পতিমশাইয়ের সঙ্গে দেখা। হালে গত হয়েছেন। ক’দিন আগেই আমাদের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো করে গিয়েছেন। তাড়াতাড়ি পায়ের ধুলো নিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলাম। দিব্যি হেঁটো ধুতি আর ফতুয়া পরে আছেন। নিজের চোখে দেখা।”
“ঠিক দেখেছ?”
“আজ্ঞে, একেবারে স্পষ্ট দেখা।”
“ইয়ে, তা তোমার ভূতের ভয়টয় নেই বুঝি?”
“তা থাকবে না কেন? খুব আছে। ওই যে দেখুন না, ষষ্ঠীতলায় বটগাছের নীচে মুকুন্দ রায় বসে আছেন। ওঁকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন যে, আমি ভূতকে বড্ড ভয় পাই।”
বগলাপতি থমকে দাঁড়িয়ে ঠাহর করে দেখলেন, বটগাছের তলায় একটা লোক বসে আছে বটে। আমতা-আমতা করে বললেন, “তা ওটা মুকুল রায়ের ভূত তোমাকে কে বলল? কেউ হয়তো ফাঁকায় এসে বসেছে হাওয়া খেতে।”
“মুকুন্দ রায়কে আমি বিলক্ষণ চিনি যে! ওইটেই ওঁর ঠেক।”
বগলাপতি দোনোমোনো করে বললেন, “দুর! ভূত নিয়ে কারবার করে বুড়ো হতে চললুম, আমি কি ভূত চিনি না!”
মুকুন্দ রায় হঠাৎ উঠে ফটফটে চাঁদের আলোয় এগিয়ে এসে ভারী বিরক্তির গলায় বলল, “কে রে, তখন থেকে ভূত-ভূত করছিস! আরে! ওটা সেই চিটিংবাজ বগলা না!”
বগলাপতি একটা আঁক শব্দ করে চোখ উলটে কাটা কলাগাছের মতো মাটিতে পড়ে গোঁ গোঁ করতে লাগলেন।
মুকুন্দ রায় অসন্তোষের গলায় বলল, “ভূতে বিশ্বাস করিস নাকি তোরা? ছিঃ ছিঃ! এই বিজ্ঞানের যুগে ওই সব কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে পড়ে আছিস! ভূতটুত কিছু নেই! বুঝেছিস! তোদের জন্যই দেশটা অধঃপাতে যাচ্ছে।”
লালমোহনবাবু এতক্ষণ কিছু বলেননি, কিন্তু এ কথায় ভারী চটে উঠে বললেন, “এ আপনার কীরকম ব্যবহার মুকুন্দদা? এ তো ভারী অন্যায়! আপনি ভূত মানেন না, বেশ ভাল কথা। কিন্তু আমরা যারা ভূতটুত মানি, তাদের উপর চড়াও হওয়া কি আপনার উচিত?”
মুকুন্দ রায়ও সমান তেজে গলা চড়িয়ে বলল, “আলবাত উচিত। লোকের ভুল ধারণা ভেঙে দেওয়াটা আমার পবিত্র কর্তব্য। যারা বলে যে ভূত দেখেছে, তারা হয় ভুল দেখেছে, নইলে মিথ্যে কথা বলে। খুব যে বড় বড় কথা কইছিস, দেখাতে পারবি আমাকে ভূত? দেখাতে পারলে বুঝব তোর মুরোদ।”
অত্যন্ত অভিমানের সঙ্গে লালমোহনবাবু বললেন, “চোখ থাকতেও যে দেখতে পায় না তাকে ভূত দেখিয়ে আমার কাজ নেই। আপনি দেহ রেখেছেন, তাও বছর ঘুরতে চলল। এত দিনেও যদি ভূত না দেখে থাকেন তা হলে আর আমার বলার কিছু নেই।”
মুকুন্দ রায় চোখ পাকিয়ে বলল, “মুখ সামলে! ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!”
লালমোহনবাবু মিইয়ে গিয়ে বললেন, “না, এই বলছিলাম কী, আপনার স্ত্রী, অর্থাৎ আমাদের বউদি যে বছরটাক ধরে বৈধব্য পালন করছেন সেটা খেয়াল রাখবেন তো! ছেলেরা ঘটা করে আপনার শ্রাদ্ধ-শান্তি করেছে, আমরা কবজি ডুবিয়ে খেয়ে এসেছি, সেটাও তো মিথ্যে নয়!”