ব্যাপারটা বড়ই গোলমেলে। কামাখ্যা মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না বটে, কিন্তু মাথাটা বড্ড গরম হয়ে গেল। নড়বড়ে চৌকিটায় শুয়ে এ পাশ ওপাশ করতে করতে রাত প্রায় কাবার। ভোরের দিকে একটু তন্দ্ৰামতো এসে গিয়েছিল।
হঠাৎ বাইরে হাঁকডাক শোনা গেল, “বগলাঠাকুর আছে নাকি! ও বগলাঠাকুর!”
কামাখ্যা উঠে দরজাটা খুলেই বাজপড়া গাছের মতো দাঁড়িয়ে রইল।
শঙ্কাহরণ একগাল হেসে বলল, “কামাখ্যাবাবু যে!”
পাশ থেকে বিপদভঞ্জন বলে উঠল, “বৃন্দাবনবাবুও হতে পারেন।”
“তা বটে!”
“কামাখ্যাবাবু কি আমাদের চিনতে পারছেন না নাকি রে শঙ্কু?”
“মানুষ চেনা কি অত সোজা রে! তবে মনে হয় চিনেও চিনতে চাইছেন না।”
দু’জনের এইসব কথাবার্তা কামাখ্যাকে স্পর্শ করা দূরে থাক, কানেও ঢুকছিল না। সে দূরাগত একটা দুন্দুভির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল। নরকের বাদ্যিবাজনা কেমন হয় তা সে জানে না বটে, কিন্তু এই দুন্দুভির শব্দটা যে সেখান থেকেই আসছে, তাতে তার কোনও সন্দেহ নেই। যে বিশাল হাঁড়িতে পাপীদের সেদ্ধ করা হয়, তার আঁচও শরীরে আগাম টের পাচ্ছিল সে। এই সকালের আলোতেও সে চারদিকে আবছা-আবছা প্রেতের নৃত্য দেখতে পাচ্ছে। নদীর দিকটা ডুমুর গাছটার তলায় বিশাল চেহারার যমদূতকেও যেন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে। বিশাল হোঁতকা, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ চেহারা, গায়ে লাল জামা, মাথায় লাল পাগড়ির মতো কিছু হাতে মুগুরটুগুর আছে বলেই মনে হল। তার শমন সুতরাং এসেই গেছে। আর এটা বুঝতে পেরেই হঠাৎ কামাখ্যার সব ভয়ডর উবে গেল।
সে বেশ বুক চিতিয়ে অকম্পিত গলাতেই বলল, “এসে গেছ বাবারা! তা তোমাদের যন্ত্রপাতি সব কোথায়?”
শঙ্কা আর বিপদ অবাক হয়ে একটু মুখ তাকাতাকি করে নিল। তারপর শঙ্কাহরণ বলল, “যন্ত্রপাতি! কীসের যন্ত্রপাতি মশাই? আমরা কি মিস্তিরি নাকি?”
কামাখ্যা বলল, “আহা, মানুষ মারতে তো ছুরিছোরা, বন্দুক পিস্তল গোছের কিছু লাগে নাকি? গলা টিপেও মারা যায় বটে! কাল যেমন মারলে! আমার অবশ্য কোনওটাতেই আপত্তি নেই।”
শঙ্কা আর বিপদ নিজেদের মধ্যে আরও একবার তাকাতাকি করে নিল। তারা অবাক হয়েছে বটে, কিন্তু ব্যাপারটা বুঝে গিয়ে শঙ্কাহরণ বলল, “তা আপনার পছন্দ কোনটা? ছুরিহোরা, নাকি পিস্তলবন্দুক, নাকি…?”
‘সব চলবে বাবারা, সব চলবে। তবে কিনা গুলিটুলি হলে মন্দ হত না। ব্যাপারটা চট করে হয়ে যেত। আগেই বলে রাখছি বাপু, বাবু বিশ্বাসের লাশের কিন্তু এখন লাখ টাকা দাম। সেই লাশের সন্ধানে বিস্তর লোক এসে গেছে। একটা বেঁটে লোক, দু-দুটো মুশকো জোয়ান। লাশ হাতছাড়া করলে কিন্তু পস্তাবে, এই বলে রাখলাম। এইবার চটপট কাজ সেরে ফ্যালো।”
শঙ্কাহরণ মাথা চুলকে বলল, “আহা, ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? এই বাবু বিশ্বাসটা কে বলুন তো?”
“কে জানে বাপু, তবে তার লাশের দাম লাখ টাকা। কাজটা সেরে বরং তোমরা তাড়াতাড়ি গিয়ে বাবু বিশ্বাসের লাশ পাহারা দাও গে। আর বাটু পরিহারকে গিয়ে বোলো, এই যে সে এবেলা-ওবেলা মানুষ খুন করে বেড়াচ্ছে এটা তার ভারী অন্যায়। এখন আর আমার ভয় কীসের, তাই উচিত কথাটাই বলছি। বাটু অতি খারাপ লোক। কথাটা বেশ চোটপাট করে পরিহারের পো’কে বলে দিয়ে তো! এবার চালাও গুলি, বসিয়ে দাও ছোরা…”
‘হচ্ছে, হচ্ছে! অত হুড়ো দিচ্ছেন কেন বলুন তো! আপনি মরার আগে যে কয়েকটি কথা পরিষ্কার হওয়া দরকার। আপনি তো গিয়ে দিব্যি নরক গুলজার করে বসে যাবেন, কিন্তু ইদিকে যে কিছু ফ্যাকড়া থেকে গেল, তার কী হবে?”
“কীসের ফ্যাকড়া?”
“বেঁটে লোকটা কে?”
কামাখ্যা ধরা গলায় বলল, “আগে বেঁটে লোকদের আমি খুব শ্রদ্ধাভক্তি করতাম হে। শুনেছিলাম, বেঁটে মানুষরা নাকি বেজায় বুদ্ধিমান হয়! কথাটা মিথ্যেও নয়। লাখ টাকার প্যাঁচে ফেলে পেটের কথা বের করে নিল, একটা পয়সাও ঠেকাল না। না বাপু, কোনও বেঁটে লোককে আমি আর চিনতে চাই না। ঢের হয়েছে। তা বাপু, আর দেরি কেন? যে কাজে এসেছ, সেটি তাড়াতাড়ি সেরে সরে পড়ো। আমি মন তৈরি করে নিয়েছি। এই চোখ বুজলাম!”
শঙ্কাহরণ মোলায়েম গলায় বলল, “আপনাকে মারলে যে বদনাম হয়ে যাবে কামাখ্যাবাবু! বাটু পরিহারের বড় উঁচু নজর। মারলে হয়তো বলবেন, একটা শুটকো লোককে মেরে নাম খারাপ করলি কুলাঙ্গার! ছুঁচো মেরে যখন হাত গন্ধই করেছিস তখন বিদেয় হয়ে যা।”
কামাখ্যা চটে উঠে বলল, “এঃ, বাটু পরিহার কোথাকার খাঞ্জা খাঁ হে, যে আমাকে মারলে তার ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ হবে? খুব তো বোয়াব দেখছি তার! দু-চারটে লাশ নামিয়েছে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে নাকি? তাকে বলে দিয়ো যে, কামাখ্যাচরণ তাকে মোটেই রেয়াত করে না। ঢের-ঢের বাটু পরিহার আমার দেখা আছে!”
“আজ্ঞে। তা সেই কথাটাই গিয়ে তা হলে বাটু পরিহারমশাইয়ের শ্রীচরণে নিবেদন করি। আজ্ঞা করুন, বিদেয় হই।”
কামাখ্যা বলল, “তা হলে তোমরা চললে!”
“যে আজ্ঞে।”
মওকাটা ফসকালে হে! এমন মওকা আর পাবে না। সাক্ষীসাবুদ নেই, বাধাবিপত্তি নেই, নিরিবিলিতে দিব্যি আমার লাশটা নামিয়ে যেতে পারতে। তা কী আর করা!
৬. ভূতের মতো এমন গোলমেলে জিনিস
ভূতের মতো এমন গোলমেলে জিনিস আর দুটো হয় না। এই আছে, তো এই নেই। সাপটে ধরার জো নেই, ভাল করে নিরিখ-পরখ করার উপায় নেই, তেমন কাজেও লাগে না। তবে ভূতের সুবিধের দিক হল, থাক বা না থাক, তাদের অনেকেই ভয় খায়। এই ভয় খাওয়াদের মধ্যে কিছু কিছু নাস্তিকও আছে, যারা ভূতকে মোটেই বিশ্বাস করে না। কিন্তু কিছু তে-এঁটে নাস্তিক আছে, যারা ভূতকে বিশ্বাসও করে না, ভয়ও খায় না। মুকুন্দ রায় এরকমই একজন নাস্তিক। সে যখন মারা গেল তখন শরীর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এসে প্রথমে আড়মোড়া ভাঙল, তারপর হাই তুলল, আর তার পরই দেখতে পেল, তার সামনে নিশাপতি দাঁড়িয়ে ফ্যাকফ্যাক করে হাসছে। মুকুন্দ রায় বিরক্ত হয়ে বলল, “আ মোলো, অমন বোকার মতো হাসছ কেন? হলটা কী?”