কামাখ্যা চাপা গলায় বলল, “তা আর নেই! তা খবরের জন্য লাশপ্রতি কত করে দিচ্ছেন?”
“আপনাদের এখানে রেট কত?”
“তা ধরুন, একশো টাকা তো হবেই।”
“দুর মশাই! আমাদের ওদিকে একশো টাকায় দশটা লাশের খবর পাওয়া যায়। দরাদরি করলে বারোটা তেরোটা অবধি।”
“আচ্ছা, না হয় পাঁচ-দশ টাকা কমই দেবেন।” বেঁটে লোকটা মাথা নেড়ে ভারী দুঃখের গলায় বলল, “না, এখানে দেখছি দর বড্ড চড়া! তার উপর লাশ যদি বাবু বিশ্বাসের না হয়, তা হলে তো টাকাটাই জলে!”
কামাখ্যা আর-একটু গলা নামিয়ে বলল, “বাবু বিশ্বাসটা কে মশাই?”
“আছে মশাই, আছে। বাবু বিশ্বাসের জন্য দুনিয়া তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে, সোজা ব্যাপার নয়। বাবু বিশ্বাসের লাশের খবর জায়গামতো পৌঁছে দিলে লাখ টাকা নগদ। হাতে-হাতে।”
কথাটা শুনে কামাখ্যার মুখ রসস্থ হয়ে পড়ল। টাকাপয়সার কথায় তার ওরকমধারা হয়। হেঃ হেঃ করে বলল, “তা খবরটা কাকে পৌঁছে দিতে হবে মশাই?”
“সেটাই তো লাখ টাকার প্রশ্ন। নইলে রাতবিরেতে বিছানার আরাম ছেড়ে এই আঁদাড়পাঁদাড়ে আমিই বা ঘুরে মরছি কেন, আর ওই ষন্ডা দুটোই বা কেন ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে? পাকা খবরের জন্য আমাদের মতো আরও কতজনা মাঠে নেমে পড়েছে কে জানে!”
“ওই ষদুটো কি তবে বাটু পরিহারের লোক নয়?”
“বাটু পরিহার! সে আবার কে মশাই?”
“আজ্ঞে, বাটু পরিহারের লোকেরাই তো খুনটা করল!”
“কোন খুনটা?”
কামাখ্যা মুখে হাত চাপা দিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আজ্ঞে, ও কিছু নয়। কী বলতে কী বলে ফেলেছি!”
“ওটাই তো ভুল করেন। গুহ্য কথা বেভুলে যাকে তাকে বলে ফেলতে নেই মশাই। আর-একটু হলেই তো পেটের কথাটা বের করে ফেলতেন! যাকগে, শেষ অবধি যে সামলে নিতে পেরেছেন, সেটাই বাঁচোয়া। তবে এ কথাও বলে রাখছি, খুনটা যদি নিজের চোখে দেখে থাকেন, আর লাশটা যদি বাবু বিশ্বাসেরই হয়, তা হলে তো কেল্লা মেরেই দিয়েছেন!”
“তা তো বুঝলুম। কিন্তু আপনি তো কেবল সাঁটে বলে যাচ্ছেন। ও থেকে জট ছাড়িয়ে আসল কথাটা বের করার কি উপায় আছে? লাখ টাকা যদি হাওয়ার নাড়ু হয়েই থেকে যায় তবে আর লাভ’কী?”
লোকটা মোলায়েম গলাতেই বলল, “দেখুন মশাই, দুনিয়ার একটা চলতি নিয়ম আছে। দোকানে গিয়ে পাঁচটা টাকা ফেলুন, এক পলা তেল পাবেন, কালীর থানে গিয়ে একটা টাকা প্রণামী খয়রাত করুন, পুরুত দু’খানা বাতাসা দেবে। গোরুকে ঠিকমতো জাবনা দিন, দেখবেন হুড়হুড় করে দুধ নামবে। নিয়মটা হল, কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। লাখ টাকার ঠিকানা আদায় করতে হলে খুনের গুহ্য কথাটা আগে উগরে দিন।”
কামাখ্যা আমতা-আমতা করে বলল, “পাঁচকান হলে যে আমার বড় বিপদ হবে মশাই!”
“আহা, বিপদ কি আপনার এখনই কম যাচ্ছে মশাই! ওই যে ষভাদুটোকে দেখছেন, ওরা কার লোক জানেন?”
“আজ্ঞে না। কার?”
“থাক, সে আপনার জেনে কাজ নেই। শুনে যদি এক্ষুনি আপনার দাঁতকপাটি লেগে চোখ উলটে যায়, তা হলে বিপদ আরও বাড়বে। তার চেয়ে, উদগার তুললে যেমন পেটের বায়ু বেরিয়ে গিয়ে আরাম হয়, তেমনই গুহ্য কথাটা উগরে দিন, দেখবেন ভয়টা একটু কমে যাবে।”
“আজ্ঞে, খুনটা হল আজ দুপুরে, পাশের চৈতন্যপুর গাঁয়ে, বিদ্যাধরীর ধারে। তবে যে খুন হল সে বাবু বিশ্বাস কিনা তা জানি না! বেশ ফরসাপানা বাবুগোছের চেহারা, পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়স, দাড়িগোঁফ আছে।”
লোকটা চাপা উত্তেজিত গলায় বলল, “শাবাশ! লাখ টাকা এখন আপনার ট্যাকে, ওই হল বাবু বিশ্বাস।”
“বলেন কী মশাই?”
“ঠিকই বলছি।”
“তা মশাই, টাকাটা কী করে পাব?”
“শ্রীরাধিকা যখন শ্রীকৃষ্ণের কাছে যেতেন, তখনকার কথা মনে আছে? সরু, ছুরির ধারের মতো পথ, তাতে জলকাদায় পিছল, তার উপর বিষধর সাপ কিলবিল করছে, তায় দুর্যোগ, তার উপর কাটাঝোঁপ, আরও কত কী! টাকাটা পেতে হলে এরকমই সব বিপদআপদ অগ্রাহ্য করে একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছতে হবে। প্রাণ হাতে করে যাওয়া।”
“কেন মশাই, প্রাণ হাতে করে যেতে হবে কেন?”
“সে আপনার জেনে কাজ নেই। হার্ট ফেল হয়ে যেতে পারে। তবে লাখ টাকার জন্য ওটুকু বিপদ যদি গায়ে না মাখেন, তা হলে আর ভাবনা কীসের?”
কামাখ্যা ভারী অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, “কথাটা আদায় করে নিয়ে এখন ছোলাগাছি দেখাচ্ছেন?”
“আরে, না! কথা আর আদায় হল কোথায়? শোনা কথার উপর লাখ টাকা ফেলার মতো আহাম্মক কি কেউ আছে? লাশই যদি না পাওয়া যায় তা হলে আর ও খবরের দামই বা কী বলুন! যে টাকা দেবে সে কি খবরের সত্যাসত্য যাচাই করতে ছাড়বে? বাবু বিশ্বাসের লাশ খুঁজতেই তো আমরা ঘুরে মরছি। তা লাশটা এখন কোথায়?”
“খুনের পর যদি লাশ বিদ্যাধরীতে ভাসিয়ে দিয়ে থাকে?”
“তা হলে লাখ টাকাও যে ভেসে গেছে মশাই! বড় ভুল করে ফেলেছেন। লাশটা আঁকড়ে ধরে সেঁটে বসে থাকতে পারতেন। তা হলে লাখ টাকা লাট খেয়ে আপনার পায়ের গোড়ায় এসে পড়ত। যান, এবার গিয়ে শুয়ে পড়ুনগে, ষন্ডা দুটো চলে যাচ্ছে। আমাকে এক্ষুনি ওদের পিছু নিতে হবে।” বলেই লোকটা টপ করে উঠে গুঁড়ি মেরে উঠোনটা পার হয়ে গেল।
জঙ্গলের মধ্যে মশা আর ভঁশের কামড়ে জেরবার কামাখ্যা তিতকুটে মুখ নিয়ে উঠল। ঘরে এসে দরজাটা বন্ধ করে জানালা দিয়ে লোকগুলোর গতিবিধি নজর করতে গিয়ে তার একগাল মাছি। উঠোনের পশ্চিমের শুড়ি পথটায় জ্যোৎস্নার আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেল, ষন্ডা দুটো হেলেদুলে যাচ্ছে। পিছন থেকে বেঁটে লোকটা দৌড়ে গিয়ে তাদের সঙ্গ ধরে ফেলল। তারপর তিনজনে নিচু গলায় কথা কইতে কইতে পথের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল।