কুটকুটে কম্বলের বিছানায় শুয়ে কি ঘুম আসতে চায়! অনেকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে বোধ হয় একটু তন্দ্রামতো এসেছিল। কিন্তু নিশ্চিন্তে ঘুমোবে তার উপায় কী? একে তো পেটে দানাপানি নেই, ভয়ের তাড়ায় খাওয়ার কথাই ভুলে মেরে দিয়েছে। তার উপর ঘুমোলেই নানারকম ভয়ের স্বপ্ন এসে হাজির হয়। আর কামাখ্যা চমকে জেগে ওঠে। তার উপর ইঁদুর দৌড়োয়, বিড়াল ডাকে। একপাল শিয়াল এসে উঠোনে বসে তারস্বরে হুক্কাহুয়া করে গেল। আর সত্যিই বাতাসে নানারকম ফিসফাস শব্দ শুনতে লাগল সে। ছোট-বাইরে সারতে দরজা খুলে ঘরের পিছন দিকটায় একটু গিয়েছিল সে। মাঝরাতে খুব ফিনকি দিয়ে জ্যোৎস্না ফুটেছে। ফিরে আসবার সময় হঠাৎ দেখতে পেল দুটো পেল্লায় চেহারার লোক উঠোনে দাঁড়িয়ে। বুকটা এমন ধক করে উঠেছিল যে, আর-একটু হলেই কেঁপে-ঝেপে মূৰ্ছা যেত। তাড়াতাড়ি আড়ালে সরে গিয়ে উঁকি মেরে দেখল, একজনের হাতে টর্চ, অন্যজনের হাতে একটা পিস্তলের মতো কিছু রয়েছে। টর্চ হাতে লোকটা খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে চারদিকে আলো ফেলে কী যেন দেখল। তারপর বেরিয়ে এসে চারদিকটা ভাল করে নিরীক্ষণ করে মাথা নেড়ে বলল, “এখানে কেউ নেই।”
এরা যে বাটু পরিহারের লোক এবং তাকেই খুঁজতে এসেছে, এ বিষয়ে কামাখ্যার আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না। অতি সন্তর্পণে সে পিছু হটে ঝোঁপজঙ্গলের ভিতরে সেঁধিয়ে গিয়ে দাঁড়াল।
বগলাঠাকুর যে ক্ষিতিবাবু, অপরেশবাবু, তেজেনবাবুর কথা বলেছিল, এই দু’জন কি তাদেরই কেউ নাকি রে বাবা! গানাবাজানা ভূতের কথাও হয়েছিল বটে, কিন্তু এদের মধ্যে ভূত-ভূত ভাবটাই তো নেই! আড়াল থেকে খুব নিবিষ্ট হয়ে দু’জনের গতিবিধি নজর করছিল কামাখ্যা। টর্চের আলো তার দিকেও বারকয়েক ধেয়ে এল, কিন্তু ঝোঁপের আড়ালে সেঁটে থাকায় তাকে নজরে পড়ার কথা নয়। তবু কামাখ্যা আরও একটু গুটিসুটি মেরে উবু হয়ে বসে বিড়বিড় করে বলল, “গতিক বড় সুবিধের নয়।”
খুব মিহিন গলায় পিছন থেকে একটি প্রতিধ্বনি এল, না, গতিক মোটেই সুবিধের নয়।
কামাখ্যা ব্যাপারটা প্রথমে খেয়াল না করে ফের বলল, “বাটুর লোক বলেই তো মনে হচ্ছে।”
মিহিন গলাটা ফের বলল, “হতেই পারে।”
কামাখ্যা এবার খেয়াল করল এবং তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ভয়ে। কে বলল কথাটা! অ্যাঁ! কে তার পিছনে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে! ভয়ে ঘাড়টা এমন শক্ত হয়ে গিয়েছে যে, মুখ ঘুরিয়ে তাকানোর অবধি জো নেই। কাঁপা কাঁপা কাহিল গলায় সে বলল, “কে আজ্ঞে? কে আপনি?”
কানের কাছে মুখ এনে মিহিন গলা বলল, “নামধাম বলার উপায় নেই মশাই। ছদ্মবেশে আছি কিনা! বিপজ্জনক কাজে বেরোলে ছদ্মবেশ ছাড়া চলে না। কিন্তু মুশকিল কী জানেন, নকল দাড়িগোঁফগুলো বড্ড কুটকুট করে।”
কামাখ্যার এবার একটু সাহস হল। ঘাড়টাও ঘোরাতে পারছে এখন। একটু বাঁকা চোখে তাকিয়ে দেখল, বেঁটেমতো রোগা গোছের একটা লোক। দাড়িগোঁফ আছে, পরনে শার্ট আর প্যান্ট, হাতে একখানা মজবুত লাঠি।
লোকটা উঠোনের দুটো ষন্ডার গতিবিধি লক্ষ করতে করতে অতি চাপা স্বরে বলল, “জ্যোৎস্না রাত আপনার কেমন লাগে মশাই?”
কামাখ্যা এখনও ঘাবড়েই আছে। হঠাৎ জ্যোৎস্নার কথা উঠছে কেন তা বুঝতে না পেরে বার দুই গলাখাঁকারি দিয়ে নিল। কোন কথার মধ্যে কোন প্যাঁচ আছে কে জানে বাবা! আমতা-আমতা করে বলল, “জ্যোৎস্না তো আর খারাপ জিনিস নয়। বেশ একটা দুধ-ভাত দুধ-ভাত ভাব আছে। লোকে তো জ্যোৎস্না রাতকে ভালই বলে।”
দুর-দুর! জ্যোৎস্না অতি নচ্ছার জিনিস। গা-ঢাকা দিয়ে কাজ করার জো আছে? অন্ধকারের অনেক সুবিধে। রাতবিরেতে যাদের কাজেকর্মে বেরোতে হয়, জ্যোৎস্নায় তাদের ভারী মুশকিল। এই যে আপনি বিষয়কর্মে বেরিয়েছেন, আপনারই কি কিছু সুবিধে হচ্ছে? গেরস্তবাড়িতে সিঁদ দেবেন, কি জানালা ফাঁক করবেন, কিংবা গ্রিল কাটবেন, বাড়ির কর্তা উঁকি মেরে দেখে চিনে ফেলল আপনাকে। কী কেলেঙ্কারি বলুন তো!”
কামাখ্যা তটস্থ হয়ে বলল, “আজ্ঞে, আমি চোর নই।” লোকটা ভারী অবাক হয়ে বলল, “নন? কী আশ্চর্য! ননই বা কেন? চুরির অনেক সুবিধে আছে মশাই। বুদ্ধিতে শান পড়ে, শরীরটা বেশ টগবগে থাকে, চারদিকে নজর রাখার অভ্যেস হয়, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব বলেও কী যেন একটা কথা আছে, সেটাও নাকি খুব বেড়ে যায়। কথাটার মানে জানেন?”
কামাখ্যা দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে না।”
“আমিও জানি না। ভাল কথাই হবে। তা হলে আপনি চোর নন?”
“আজ্ঞে না। ছোটখাটো একটু ব্যাবসামতো আছে।”
“চোর হলে বড় ভাল হত মশাই। চোরেরা গাঁয়ের হালহদিশ সব জানে কিনা! তাদের কাছে অনেক গুহ্য খবর পাওয়া যায়।”
কামাখ্যা ঘাড় কাত করে সায় দিয়ে বলল, “যে আজ্ঞে! চোরডাকাতও কিছু খারাপ নয়। অনেক কাজে লাগে। তা কোন গুহ্য খবর জানতে চাইছেন আজ্ঞে?”
“সেটা কি ফস করে বলে ফেলা ঠিক হবে? পাঁচকান হয়ে গেলে গুহ্য কথা কি আর গুহ্য কথা থাকে?”
“তা অবিশ্যি ঠিক। তবে গাঁ-গঞ্জ জায়গা তো, কোনও কথাই তেমন ঢাকা-চাপা থাকে না। চাউর হয়ে পড়ে।”
চাপা গলাতেই কথা হচ্ছে, তবু লোকটা গলা আরও এক পরদা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, “আচ্ছা, এই অঞ্চলে কি কোনও লাশের খবর আছে?”