গোবিন্দ ঘোষাল বিছুটি হাসি হেসে বললেন, “লোকে কিন্তু অন্য কথাও বলে!”
বগলাপতি উদাস মুখে বললেন, “লোকে যা বলে তাও মিথ্যে নয় দাদা। লোকে বলে, আমি নাকি আসলে ভূতের ভয়ে পালিয়ে যাই। তা সেটা অস্বীকার করি কী করে? ঠিক ভূতের না হলেও ভূতের গানবাজনার ভয়ও তো আছে!”
গোবিন্দ ঘোষাল অবাক হয়ে বললেন, “ভূতের গানবাজনা! সে আবার কী জিনিস হে?”
“আর কবেন না দাদা! আমার তো দু’টি বই ভূত নেই। দুটিই অতি নচ্ছার দেহাতি ভূত। রাতবিরেতে তাদের একজন বেতালে ঢোল বাজায় আর অন্যজন বেসুরো গলায় গান গায়। ওই জন্যই তো দু’জনের নাম দিয়েছি গানাবাজানা। তাদের গানবাজনার ঠেলায় সাধনপীঠে কি শান্তিতে থাকবার যযা আছে মশাই? রাত ভোর হওয়ার আগে তা ক্ষান্ত হয় না।”
গোবিন্দ ঘোষাল আর কথা বাড়াননি। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, “তুমি খুব উঁচুদরের সাধক হে, চালিয়ে যাও!”
বগলাপতি নির্বিকারভাবে বললেন, “কথাটা লিখে দেবেন দাদা, বাঁধিয়ে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখব।”
তা কাল রাতেও বগলাপতি যখন বাড়িমুখো রওনা দিচ্ছেন তখন কামাখ্যা আপত্তি জানিয়ে বলেছিল, “আমাকে এখানে একা ফেলে যাচ্ছেন, ভালমন্দ একটা কিছু হয়ে গেলে কী হবে?” বগলাপতি অবাক হয়ে বললেন, “একা! একা কেন রে? দুনিয়ায় কি একা হওয়ার যো আছে? এই তো ক্ষিতিবাবু আছেন, অপরেশবাবু আছেন, তেজেন্দ্রবাবুও হাজির! মরুবাবুও জেঁকে বসে আছেন, ব্যোমকেশবাবুকে তো নড়ানোই যায় না। পাঁচজনে গলাগলি ভাব। পঞ্চভূত বলে কথা!”
কামাখ্যা সন্দিহান হয়ে বলল, “এরা সব কারা মশাই? লোক ভাল তো?”
“বিশিষ্ট লোক রে, সব বিশিষ্ট লোক! ওই যে আমগাছটা দেখছিস, ওটা আবার কথাটথা কয়। রাতবিরেতে কান পাতলে শুনবি এদিককার এই কদম গাছটার সঙ্গে চাপানউতোর চলছে।”
“বলেন কী মশাই! গাছে-গাছে ঝগড়া! জন্মে শুনিনি!”
“তবে আর সাধনপীঠের মহিমা কী? তারপর ধর বাতাসে গিজগিজ করছে অশরীরীদের ভিড়, তাদেরও কত সুখ-দুঃখের কথা আছে। সারা রাত গুজগুজ ফিসফাস, কোনও বউ হয়তো শাশুড়ির গঞ্জনার কথা কয়, কোনও কেরানি হয়তো উপরওলার অত্যাচারের কথা কইতে গিয়ে হাপুস নয়নে কাঁদে, কত রাজাগজা এখনও তম্বি করে বেড়ায়। হ্যাঁ রে কামাখ্যা, তুই কি ইঁদুরের বা বাদুড়ের ভাষা বুঝতে পারিস?”
কামাখ্যা কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “আজ্ঞে না, ওটা শেখা হয়ে ওঠেনি।”
“শিখে রাখলে পারতি রে! এখানে বলিয়েকইয়ে ইঁদুর আর গল্পবাজ বাদুড়ের অভাব নেই কিনা! একটা ইঁদুর হয়তো ঘরে ঢুকে তোকে দেখেই থতমত খেয়ে বলে উঠল, ‘এই যে কামাখ্যাবাবু, নমস্কার! কী সৌভাগ্য আমাদের! তা আপনি এখানে যে! কোনও বিষয়কৰ্ম আছে নাকি?’ ভাষাটা বুঝলে তুইও তখন গল্প ফেঁদে বসে যেতে পারতিস। কিংবা ধর, ছোট বাইরে করতে বেরিয়েছিস, হঠাৎ একটা বাদুড় এসে তোকে দেখে ভারী খুশি হয়ে বলল, ও মা! কামাখ্যাবাবু না? এঃ, বড্ড রোগা হয়ে গেছেন দেখছি! তা বন্ধকি কারবারটা কেমন চলছে?’ ভাষাটা ধরতে পারলে তুইও তখন দিব্যি গল্পগাছা করে খানিকটা সময় কাটিয়ে দিতে পারতিস।”
কামাখ্যা মাথা নেড়ে বলল, “না মশাই, ইঁদুর বাদুড়ের সঙ্গে কথা কয়ে রাতের ঘুম নষ্ট করতে পারব না।”
“আহা, তা তো বটেই। তবে কিনা, কথাটা হল, একা হওয়ার কি যো আছে রে? মিলেমিশে থাকলে দেখবি মোটেই একা লাগবে না।”
কামাখ্যা হতাশ হয়ে বলল, “ভূত-প্রেত, কথাকওয়া ইঁদুর, আড্ডাবাজ বাদুড়, মশাই, আর বাকি রইল কী? এ তো মুশকিলেই পড়া গেল দেখছি!”
মুশকিলটা হল রাত্রে।
বগলাপতি আর লালমোহন বিদায় হওয়ার পর কামাখ্যা ঘরে ঢুকে হ্যারিকেনের আলোয় যা ব্যবস্থাদি দেখতে পেল, তাতে খুশি হওয়ার কথা নয়। কেরাসিন কাঠের নড়বড়ে চৌকির উপর একটা কালো কুটকুটে কম্বল পাতা। বালিশটালিশ নেই। ঘরের দরজায় বাটাম আছে বটে কিন্তু কপাটের এমনই অবস্থা যে, বিড়ালে গা ঘষলেও দরজা ভেঙে পড়বে। অশরীরী পাহারাদারদের উপর তেমন ভরসা নেই কামাখ্যার। কপাটটা মজবুত হলেও না হয় কথা ছিল! বাটু পরিহার যে রাতবিরেতে এসে হাজির হবে না এমন কোনও কথা নেই। বাটুকে হাড়ে হাড়ে চেনে কামাখ্যা। সেবার গোসাঁইপাড়ায় নপু গোসাঁইয়ের বাড়ি মালসাভোগের নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে বাটু পরিহারের চকচকে পাম্পশু মাড়িয়ে ফেলেছিল সে। তা নেমন্তন্ন বাড়িতে ওরকম তো হয়েই থাকে। জুতোজোড়া যে বাটুর তা তো আর সে জানত না। আর এও জানা ছিল না যে, বাটুর জুতোজোড়ার উপর নজর রাখার জন্য একজন পাহারাদার মোতায়েন আছে।
“বাটুবাবুর জুতোয় পা দিস, কে রে তুই? ঘাড়ে ক’টা মাথা?” বলে মুশকো চেহারার পাহারাদারটা তেড়ে এল। চারদিকে ভয়ে আতঙ্কে তুমুল চেঁচামেচি আর ছোটাছুটি পড়ে গেল। সবাই জানে, বাটুর কাছে মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কোনও দণ্ড নেই। আর মৃত্যুদণ্ডটাও খুবই সরল ও সংক্ষেপ। ঘাড় থেকে মাথাটা নামিয়ে দেওয়া। কামাখ্যার সেদিনই হয়ে গিয়েছিল। তবে বরাতজোরে অল্পের উপর দিয়ে বেঁচে যায়। নন্দবাবুই এসে বাটুকে ধরে বললেন, “ও বাবা বাটু, আজ পুজোকাটালি দিন, গোসাইবাড়িতে রক্তপাতটা কোরো না বাবা?”
তা বাটুরও সেদিন মেজাজটা ভাল ছিল। তাই মোটে দশবার সকলের সামনে কান ধরে ওঠবোস করিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল বাটু। বরাতজোরে ঘাড়টা সেদিন বেঁচে যায় বটে, তবে ঘটনাটা মনে পড়লে ঘাড় আজও সুড়সুড় করে।