করালীডাক্তার খিটখিটিয়ে উঠে বললেন, “তা হতেই পারে। বিড়ালের কাশি হয়, বাঘের মৃগী হয়, কুমিরের ম্যালেরিয়া হয়, গাছের বাতব্যাধি হয়। বিচিত্র কী?”
“আহা, রেগে যাচ্ছ কেন? আসলে ভোলানাথের তো ভীষণ জ্বর। বেঁহুশ হয়ে পড়ে আছে। ভাবছিলাম, বিড়ালটা তো এরকম অদ্ভুত শব্দ কখনও করে না, কোনও অমঙ্গল হবে না তো গো ছেলেটার?”
করালীডাক্তার খুবই তেতো গলায় বললেন, “আচ্ছা, আমি একজন এম বি বি এস পাশ, তিরিশ বছর প্র্যাকটিস করা ডাক্তার হয়েও যদি ভোলানাথের অবস্থা বুঝতে না পারি, তা হলে কি বিভূতির বিড়াল বেশি বুঝবে?”
সুরবালা ছলছলে চোখে বললেন, “তা তো বলিনি। বলছিলাম কী, অবোলা প্রাণীরা তো অনেক কিছু টের পায়। শুনেছি, গিরগিটিরা ভূমিকম্পের আগে টের পায়। পিঁপড়েরা বন্যার আগে টের পায়। এই তো সেদিন ভূষণবাবু মারা যাওয়ার আগের রাতে ভুলো কুকুরটা কেমন ভেউ-ভেউ করে কাঁদছিল।”
“ভূষণবাবুর কত বয়স হয়েছিল জানো? একশো তেরো বছর। ভূষণবাবুর বড় ছেলের বয়স নব্বই, মেজোর ঊননব্বই, আর ছোট ছেলের সাতাশি। ভূষণবাবু মারা যাওয়ার পর সম্পত্তি নিয়ে তিন বুডোর সে কী ঝগড়া, হাতাহাতির উপক্রম। তা তারাই কেউ কাদল, ভুলো কুকুরের কোন গরজ পড়েছে ভূষণবাবুর জন্য চোখের জল ফেলার?”
“তুমি যে কিছুই গ্রাহ্যি করো না, এ কিন্তু ভাল নয়। একটু আগে যে একটা প্যাচা অদ্ভুতভাবে ডাকছিল, সে কি এমনি?”
করালীডাক্তার নির্বিকারভাবে বললেন, “ডাকার জন্যই পাচারা মাইনে পায়।”
এ কথায় সুরবালার পিত্তি জ্বলে গেল। কিন্তু আর কথা বাড়ালেন। করালীডাক্তারকে তিনি হাড়ে হাড়ে চেনেন।
ছেলেটাকে দেখা ইস্তক তাঁর বড় মায়া পড়ে গেছে। কী সুন্দর কেষ্টঠাকুরের মতো মুখোনা! তাঁর নিজের একটা ছেলে থাকলে আজ এত বড়টিই হত। কোন বাড়ির ছেলে, কোথা থেকে এল, কী হয়েছিল, কিছুই জানার উপায় নেই। যতক্ষণ হুশ ছিল একটাও কথা বলতে পারেনি। করালীডাক্তার বলেছেন, স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে। শুনে অবধি সুরবালার মনটা হায়-হায় করছে। সারা রাত উঠে-উঠে গিয়ে তার নাকে হাত দিয়ে দেখেছেন, খাস চলছে কি না, জ্বর কমেছে কি না। আর সারা রাত কত যে অলক্ষুনে শব্দ শুনেছেন তার হিসেব নেই। এই শিয়াল ডাকল তো ওই শোনা গেল তক্ষকের শব্দ। হঠাৎ একটা কাক খা-খা করে উঠল। এই কুকুরের ঝগড়া তো ওই বিড়ালের ফ্যাস-ফাঁস। সুরবালার স্থির বিশ্বাস, এসব মোটেই শুভ লক্ষণ নয়। কিন্তু করালীডাক্তারকে বলে তো কোনও লাভ নেই।
সকালে দেখা গেল, ভোলানাথের জ্বর একটু কম। চোখ চেয়ে এদিক-ওদিক কাকে যেন খুঁজছে। বাচ্চারা মা ছাড়া এ সময়ে আর কাকেই বা খুঁজবে? সুরবালা তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ে বললেন, “কাকে খুঁজছ বাবা? মাকে?”
ভোলানাথ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। মুখে কথা নেই। “তোমার বাড়ি কোথায় বাবা? বাড়িতে কে কে আছে?” ভোলানাথ জবাব দিল না।
অনেক চেষ্টা করে সুরবালা হাল ছাড়লেন। তারপর শঙ্কাহরণ আর বিপদভঞ্জনকে ডেকে বললেন, “শোন বাবারা, ডাক্তারি চিকিৎসায় আমার যেন কেমন ভরসা হচ্ছে না। তোরা বরং লুকিয়ে বগলাঠাকুরকে একটা খবর দিয়ে আয়। প্রেসিদ্ধ মানুষ, শুনেছি মন্তরতন্তরের জোর আছে। এই তো সেদিন বাসন্তীর হারানো ছাগলটা খুঁজে দিল। পুণ্যবাবুর বাতব্যাধি সারিয়ে দিল।”
শঙ্কাহরণ চোখ বড় বড় করে বলল, “কিন্তু মাঠান, বগলাঠাকুরের আগমন হলে যে কর্তাবাবু আমাদের আস্ত রাখবেন না। বগলা তান্ত্রিকের উপর যে উনি সাংঘাতিক খাপ্পা। চোর, ধাপ্পাবাজ, শয়তান কত কী বলেন?”
“উনি কার উপর খাপ্পা নন, বল তো! সবাইকেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন বলেই তো গাঁয়ের লোক ওঁকে পছন্দ করে না। আজকাল তো অনেকের বিয়ে বা শ্রাদ্ধে আমাদের নেমন্তন্ন হয় না।”
বিপদভঞ্জন বলল, “গাঁয়ের লোকগুলোর কথা আর কবেন না মাঠান। প্রাণ নিয়ে টানাটানি হলে করালীডাক্তারের পায়ে পড়ে। কিন্তু কাজ উদ্ধার হয়ে গেলে আর চিনতে চায় না।”
“তা সে যাই হোক, বেলা দশটায় উনি চেম্বারে যাবেন। তখন গিয়ে চুপটি করে ডেকে আনিস। মন্তরতন্তরে অনেক সময় কাজ হয়।” শঙ্কাহরণ মাথা চুলকে বলল, “কিন্তু গেলবার কর্তাবাবুর রুগি চারু ঘোষকে বগলাবাবা জলপড়া খাইয়েছিলেন বলে কর্তাবাবা দা নিয়ে এমন তাড়া করেছিলেন যে, বগলাপতি পাঁইপই করে ছুটে সেই শ্বশুরবাড়িতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তিন মাস এমুখো হননি। শেষে বগলাপতির শালা সম্বন্ধীরা এসে কর্তাবাবার হাতে-পায়ে ধরে বগলাপতিকে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করে।”
৫. সন্ধের পর বগলাপতি
সন্ধের পর বগলাপতি সাধনপীঠে থাকেন না, বাড়ি ফিরে যান। একদিন কালীভক্ত গোবিন্দ ঘোষাল জিজ্ঞেস করেছিলেন, “বাপু হে, একখানা সাধনপীঠ তো বোকা লোকদের মাথায় হাত বুলিয়ে বানিয়ে নিয়েছ। তা নিশুত রাতে সাধন-ভজন না করে গুটিগুটি বাড়ি গিয়ে সেখোও কেন? কীরকম সাধক হে তুমি?”
বগলাপতি বললেন, “না দাদা, আমার বড় সর্দির ধাত। নদীর ধারের ভেজা বাতাস আমার সহ্য হয় না। ঠান্ডা লেগে যায়।”
“হাসালে ভায়া! যারা সাধন-ভজন করে তাদের গা এত গরম হয়ে ওঠে যে, হলকা বেরোয়। ওই হা কুঁড়ে জোলো বাতাসের সাধ্যি কী শরীরের ভিতরে ঢুকবে!”
বগলাপতি অতি বিজ্ঞের হাসি হেসে বললেন, “তা তো বটেই। আমার শরীরে তো একশো দশ ডিগ্রি অবধি তাপ উঠে যায়। সেই অবস্থায় আমাদের মেনি বিড়ালটা একবার কোলে এসে বসেছিল। পরদিন তার গায়ে দেখি, বড়বড় ফোস্কা। কিন্তু কথা কী জানেন, ওই ধ্যান যেই শেষ হয় অমনই হু-হুঁ করে তাপটা নেমে যায়, আর তখনই ঠান্ডাটা লাগে।”