এ কথায় বিরজা কী বুঝল কে জানে। তবে মুখটা শুকনো করে চলে গেল।
একটু বেলার দিকে জটেশ্বর এসে হাজির হতেই করালী খাপ্পা হয়ে বললেন, “এ নিশ্চয়ই তোমার কাজ!”
জটেশ্বর নিরুদ্বেগ মুখে বারান্দার চেয়ারে বসে বললেন, “তা তো বটেই। কিন্তু কোন কাজটার কথা বলছ? সারাদিনে লোকের শতেক কাজ থাকে। কোন কাজটার কথা হচ্ছে সেটা খোলসা করে না বললে বুঝব কী করে?”
“লোটার কথা সারা গায়ে রটিয়ে বেড়িয়েছ, আর সকাল থেকেই নানা মতলবে নানা লোক এসে হাজির হচ্ছে।”
“আহা, রটাতে যাব কেন? অঘোরগঞ্জ ছোট জায়গা, হাওয়ায় খবর ছড়িয়ে যায়। বটব্যালের বাতব্যাধি থেকে অটলবাবুর পটলতোলা অবধি কোন খবরটা গোপন আছে বলতে পার? তা তোমার অতিথির খবর কী? সে কি এখনও বেঁচেবর্তে আছে? তোমার চিকিৎসায় তো তার পটলতোলার কথা! তোলেনি এখনও?”
করালী চিন্তিত মুখে বললেন, “না হে।”
জটেশ্বর উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, “এখনও গ্যাট হয়ে বসে আছে নাকি?”
“মরার মতো অবস্থা নয়। তবে তার কিছু মনে পড়ছে না। এমনকী শঙ্কাহরণ, বিপদভঞ্জন আর গিন্নি মিলে অনেক চেষ্টা করেও তাকে কথা পর্যন্ত বলাতে পারেনি। কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।”
“সর্বনাশ! তবে তো ভাল জ্বালা হল!”
“তা হল। জলে ডুবে থাকলে অনেক সময় এরকম হতে পারে। তার উপর গুলি লেগেছে।”
“আরে, একটা তেজি ওষুধ বা ইনজেকশন দাও না ঠুকে! নইলে এক দলা চ্যবনপ্রাশ খাইয়ে দাও। সঙ্গে একোনাইট থার্টি বা পালসেটিলা…”
করালী ভ্রু কুঁচকে বললেন, “আর ডাক্তারি বিদ্যে ফলিয়ো না তো! ওটা পয়সা খরচ করে শিখতে হয়, বুঝলে?”
“পয়সা খরচ করলেই কি আর শেখা যায় হে! তা হলে তো তুমিও শিখতে! একটা জলেডোবা রুগিকে ভাল করতে পারলে না, আবার ডাক্তারি শেখাচ্ছে! যাও, বরং বউঠানকে চায়ের কথাটা বলে এসো গিয়ে!”
করালীডাক্তার জটেশ্বরের দিকে রোষকষায়িত লোচনে একটু চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “ডাক্তার ভগবান নন, এটা মনে রেখো!”
“যাক, পাপমুখে তবু ভগবানের নামটা উচ্চারণ করলে। আজ ভগবান যে কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছেন কে জানে! তা তোমার ডাক্তারি বিদ্যেয় যখন হল না, তখন আমিই বরং ছোঁকরাকে একটু নেড়েচেড়ে দেখি?”
“কী দেখবে, কুষ্ঠি না কররেখা? দুটোর কোনওটাই তো তুমি জান না। বুজরুকি দিয়ে কি আর সব হয়? দেখতে চাও, দেখতে পারো। আমার আপত্তি নেই!”
“যা দেখার আমি কালকেই দেখে নিয়েছি। শুধু কররেখা আর কোষ্ঠীই নয় হে, কপাল দেখেও অনেক কিছু বলে দেওয়া যায়। ওসব তুমি বুঝবে না।”
“তা কপাল দেখে কী বুঝেছ সেটাই না হয় বলো।”
“তা তোমাকে বলতে যাব কেন? বিদ্যেটা আমাকেও পয়সা খরচ করেই শিখতে হয়েছে।”
“পয়সা খরচ করে কেউ জ্যোতিষ শেখে নাকি? গুল-গল্প আর মিথ্যে কথা বলতে কি আর বিদ্যের দরকার হয় হে?”
জটেশ্বর একটা উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বললেন, “বিদ্যে না লাগলেও প্রতিভার দরকার হয়। এখন বলো তো বাপু, ছোঁকরাকে সত্যিই কেউ গুলি করেছিল নাকি?”
করালীডাক্তার মাথা নেড়ে বললেন, “সেটাই মনে হচ্ছে। তবে ইজুরি সামান্য, পেটের একধার দিয়ে গুলি ঢুকে বেরিয়ে গিয়েছে। রক্তপাত হলেও ক্ষত মারাত্মক নয়। আইনমতো ঘটনাটা পুলিশকে জানানো দরকার।”
জটেশ্বর হাত তুলে বললেন, “রক্ষে করো বাপু, ও কাজ আর করতে যেয়ো না! মনোহরদারোগা বোমা বন্দুক শুনলেই মূৰ্ছা যায়।”
করালীডাক্তার ভাবিত মুখে বললেন, “ছোঁকরা গুন্ডা বদমাশের পাল্লায় পড়েছিল বলেই মনে হয়। আবার এও হতে পারে যে, ছোঁকরা নিজেও ওই দলেরই। গুন্ডারা গুডার হাতেই বেশি মরে। কিন্তু স্মৃতি না ফিরলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে না। ইতিমধ্যে আমার গিন্নি তো ছেলেটাকে প্রায় কোলে নিয়ে বসে আছেন। আদর করে নাম দিয়েছেন ‘ভোলানাথ। ছেলেপুলে নেই বলে অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে দেখলেই ওঁর মাতৃভাব উথলে ওঠে।”
“উনি তোমার মতো পাষণ্ড নন বলেই ওরকম করেন। কিন্তু তুমি তো চিন্তায় ফেলে দিলে হে!”
“চিন্তারই কথা। ছোঁকরার মানিব্যাগে হাজার পাঁচেক টাকা আছে। গলায় সোনার চেন আর হাতে হিরের আংটি মিলিয়ে বিশ পঁচিশ হাজার টাকার পাল্লা। কবজির ঘড়িখানাও বিদেশি। রীতিমতো মালদার লোক।”
“মানিব্যাগে কাগজপত্র কিছু পেলে না?”
“সেগুলো জলে ভিজে প্রায় গলে গেছে। টাকাগুলোরও ওই একই দশা। শঙ্কাহরণ আর বিপদভঞ্জন সেগুলোকে ছাদে নিয়ে গিয়ে রোদে শুকিয়ে এনেছে। নাঃ, নাম-ধাম, পরিচয় কিছুই জানার উপায় নেই। ছেলেটা কথা কওয়া শুরু করলেই একমাত্র হদিশ পাওয়া যেতে পারে।”
“মূক-বধির নয় তো?”
“না। শুনতে পাচ্ছে। আমার গিন্নি যা বলছে তা লক্ষ্মীছেলের মতো শুনছে। ‘খাও’ বললে খাচ্ছে, দাঁড়াতে বললে দাঁড়াচ্ছে, বসতে বললে বসছে।”
জটেশ্বর হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে বললেন, “হুঁ।”
.
কাল রাতে বিভূতিবাবুদের বিড়ালটা এমন বিচ্ছিরি খক-খক করে শব্দ করছিল যে, সুরবালা ভারী ভয় পেয়ে গেলেন। অবশ্য সুরবালার ভয় আর দুশ্চিন্তার কোনও অবধি নেই। চারদিকে এত বিপদআপদ আর ভয়ভীতি নিয়ে যে কী করে মানুষ বেঁচেবর্তে আছে, সেটাই তিনি বুঝতে পারেন না। চারদিকে সর্বদাই নানা অমঙ্গলের সংকেত দেখতে পান তিনি। তাই বিড়ালটার ওই শব্দ শুনে করালীডাক্তারকে গিয়ে ভারী মিষ্টি করেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, “হ্যাঁ গো, বিভূতির বিড়ালটার কি কাশি হয়েছে?”