- বইয়ের নামঃ চাঁদ জেগেছে নদীর বুকে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ পাঠশালা
- বিভাগসমূহঃ ছড়াসমগ্র
অমর নাম
একটি ছেলে, গাঁয়ের ছেলে
মাঠে-ঘাটে ছোটে,
রোদের মতো তাজা হাসি
ফোটে যে তার ঠোঁটে।
ঘাসের দিকে, লতার দিকে
তাকায় ভালোবেসে,
মধুমতী নদী তাকে
দেখে ওঠে হেসে।
এই ছেলেটি বড় হয়ে
দেশের লোকের তরে,
শক্রসেনার সঙ্গে জীবন
বাজি রেখে লড়ে।
জেল জুলুমে দিন কাটে তার,
ভয় পায় না মোটে,
মুক্তি পেলে তার মিছিলে
সবাই এসে জোটে।
গাছের পাতা, ধূলিকণা
বলছে অবিরাম,
‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
অমর তোমার নাম।
আমার শহর
ঢাকা শহর, আমার শহর
সব শহরের সেরা।
ধুলো দিয়ে মোড়া এবং
রিকশা দিয়ে ঘেরা।
দিনদুপুরে মাঝপথে লোক
করে চলাফেরা,
রাতদুপুরে হরহামেশা
বেলতলা যায় নেড়া!
মাথায় বাড়ি দিলেও কেউ
করে নাকো জেরা,
মানুষগুলো শান্ত যেন
গরু, ছাগল, ভেড়া।
বাদশাজাদীর বসত হেথা,
চক্ষু পটলচেরা,
পথে ঘাটে স্বপ্ন কত
হচ্ছে শুধু ছেঁড়া।
ঢাকা শহর, আমার শহর
সব শহরের সেরা।
আমার কথা সত্য কিনা
দেখো বেঁধে ডেরা।
এই গলিতে
এই গলিটা সরু এবং এদো বটে,
কিন্তু চমৎকার।
এই গলিতে থাকে উকিল, কেরানি আর
সীধু, গণৎকার।
এই গলিতে রৌদ্র ওঠে, বৃষ্টি পড়ে,
নামে অন্ধকার।
হঠাৎ কখন ঘূর্ণি হাওয়া আসে নিয়ে
ঝড়ো ছন্দ তার।
এই গলিতে দুধ বিহনে উপোস করে
বুকের মানিক কার?
এই গলিতে মধ্যরাতে টাকা গোনে
ঝানু আড়তদার।
এই গলিতে আছেই লেগে ছিঁচকে
চোরের
ছুটকো অত্যাচার।
এই গলিতে নতুন দিনের নতুন মানুষ
তোলে ঝান্ডা তার।
একি আজব
একি আজব কাণ্ড ঘটে
দিন দুপুরে ঢাকায়-
এতটুকুন হলদে পাখি
মোটর গাড়ি হাঁকায়,
আধখানা চাঁদ আটকে গেলো
মোটর গাড়ির চাকায়।
নীল পরী আর লাল পরীরা
চলছে মুটের ঝাঁকায়,
ফেরেশতারা মিটিং করে
চুপসে খাঁ খাঁ ফাঁকায়।
বাঁদরগুলো শক্ত সিধে
রাস্তাগুলো বাঁকায়,
তাগড়া যত লোকেরা সব
প্রজাপতির ঘা খায়,
তাই না দেখে পালোয়ানেরা
চোখ কেবলি পাকায়।
এসব দেখে ভারি মজা
চুপটি করে থাকায়।
খোকার প্রার্থনা
দারুণ ক্ষ্যাপা মানুষগুলো
বিশ্বটাকে করবে ধুলো,
এই করেছে পণ।
দলে দলে আসছে তেড়ে
পণ করেছে নেবে কেড়ে
সাতটি রাজার ধন।
বোমা নিয়ে কাড়াকাড়ি
তেপান্তরে মারামারি;
বাধলো বুঝি রণ।
বাঘ-ভালুকে লড়াই করে,
নানা ভিটায় ঘুঘু চরে-
শুনছি বিবরণ।
আমাদের এই খেলাঘরে
তাদের বোমা যদি পড়ে,
খোদা তখন পুতুলগুলো
গুড়িয়ে যেন না হয় ধুলো-
করি নিবেদন।
জ্যোৎস্না-রাতে
জ্যোৎস্না-রাতে দিঘির কাছে
গিয়ে দেখি তিনটি পরী নাইছে।
তারা সবাই জল ছিটিয়ে
মধুর সুরে অচেনা গান গাইছে।
এমন দৃশ্য দেখবে যারা,
তারা সবাই খুশির ঢেউয়ে ভাসবে।
তোমরা যারা পরী দেখে
হবে খুশি, জানি তারাই ছুটে আসবে।
দিঘির জলে পরী দেখার
সুযোগ আমি কখনো তো পাইনি।
দৃষ্টি থেকে তিনটি পরী
এক পলকে যাক মিলিয়ে, চাইনি।
বিষ্টি পড়ে
বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর পাড়াতলীর
বিলে,
বিলের পাড়ে শিল কুড়াতে যাবো সবাই
মিলে।
বিষ্টি পড়ে হাঁসের পাখায়, বুড়ো বটের
চুলে,
বাগদি পাড়ার সুন্দরী বউ দেখে ঘোমটা
খুলে।
বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর মেঘনা নদীর
বুকে,
সবির মাঝি বাইছে লগি সামনে ঝুঁকে
ঝুঁকে।
বিষ্টি পড়ে নবাবপুরে, জিন্দাবাহার
লেনে,
খোকন সোনা ঘুমিয়ে পড়ে গায়ে চাদর
টেনে।
ভেজা কাকের মতো শহর রা কাড়ে না
মোটে,
হঠাৎ ফোটে হাসির ঝিলিক কাজলা
মেয়ের ঠোঁটে।
দিনদুপুরে রাত্রি নামে, রাস্তা ভীষণ
ফাঁকা,
ঠাণ্ডা ভয়ে কাঁপতে-থাকা কাক ডেকে
যায় কা কা।
বিষ্টি পড়ে থুরথুরে এক বাড়ির খোলা
ছাতে,
অন্ধ হাওয়া অন্ধকারে ঝোড়ো খেলায়
মাতে।
এক পলকে পানির তোড়ে গলি হলো
নদী
লন্ড্রি ভাসে, ভাসে দোকান, মহাজনের
গদি।
গাছের ডালে কোন জাদুকর ফোটায়
কদম তাজা?
আমার পাতে ইলিশ পড়ে, সর্ষে তেলে
ভাজা।
মজার মানুষ
এক যে ছিল মজার মানুষ,
নাম ছিল তার পিটার।
ছিল নাকো ঠিক ঠিকানা
চাল চুলো আর ভিটার।
জ্যোৎস্না-রাতে বনবাদাড়ে
বাজাতো সে গিটার।
বলতো হেসে-‘চাঁদের গড়ন
বড় দিনের পিঠার’।
শীতের রাতে ছু মন্তরে
বানাতো সে হিটার।
মুঠো মুঠো কুড়ায় আলো
ঘরের ভেতর পড়ার শেষে
বইটা রেখে রাত্রিবেলা
জানলা দিয়ে দেখলো খোকন
নীল আকাশে তারার মেলা।
দেখলো বাঁকা চাঁদটা যেন
রূপোয় গড়া নৌকো এক
বলছে হেসে-তোরা সবাই
দেখরে আমার রূপটি দ্যাখ’।
চাঁদের কথা শুনে খোকন
একটুও ভাই যায়নি চটে,
এই কথাটা বাড়ির ভেতর
খানিক পরে গেলো রটে।
চাঁদের ভেলা দূর আকাশে
ভাসতে দেখে লাগে ভালো,
সোনামণি দু’হাতে তাই
মুঠো মুঠো কুড়ায় আলো।
লোকটার হাসি
লোকটা খুবই মজার বটে,
হাসছে শুধু হাসছে,
তার সে হাসি থামে না আর
একটু নেচে কাশছে।
তার সে মজার হাসি শুনে
পাড়ার সবাই দুলছে,
হঠাৎ ওরা কোন্ খেয়ালে
গায়ের জামা খুলছে।
তাই না দেখে গাছের পাখি
সবাই বেজায় হাসছে।
হাসির চোটে নাস্তা সবার
মেঘের পাড়ায় ভাসছে!