রাক্ষুসে ক্ষুধা
দুটো চকচকে বাদামী ক্যাপসুল গিলে নিল মনরো। তাকাল আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে। হাসল। আজকাল আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে হাসতে পছন্দ করে মনরো। তার দাঁতগুলো এখন ধবধবে সাদা। দশ বছর বয়স থেকে প্রতি বছর তিন মাস দাঁতের ডাক্তারের চেম্বারে যাতায়াত তার নিত্য রুটিনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এখন তার দাঁতে কোনও সমস্যা নেই। সমান, মসৃণ, চৌকোনা দাঁতগুলো হিরের মত ঝকঝক করছে।
এক কদম পিছিয়ে এল মনরো, কনুই ঘষা খেল বাথরুমের বিদ্যুৎ- বাতির সুইচে। মাথার ওপরের বাতিটি নিভে গেল। তবে মনরো আঁধারেও দিব্যি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সবকিছু। ওর জীবনে এটা আরেকটা চমকপ্রদ ঘটনা; ওর আশ্চর্য নৈশ-দৃষ্টি। ক্যাপসুলগুলো খাওয়ার পর থেকে মনরোর জীবনে অভূতপূর্ব সব পরিবর্তন ঘটে চলেছে। সবচেয়ে পরিবর্তন এসেছে খাদ্যাভ্যাসে। যে মনরোর এক সময় খাবার দেখলেই গা গোলাত এখন তার খিদে বেড়ে গেছে বহুগুণ।
বোর্ডিং হাউজের ডাইনিং রুমে ঢুকল মনরো। তার টেবিলটা যথারীতি খানি অথচ মাসখানেক আগেও টেবিলটা খালি পেত না সে। আজকাল মনরো নিঃশব্দে খাওয়া সারে, তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে থাকা অন্য ভাড়াটেদের দৃষ্টি অগ্রাহ্য করেই, তারপর বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। ওর একটু এক্সারসাইজ করা দরকার। হ্যাটখানা মাথায় চাপিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল মনরো!
রাস্তায় নেমে বুক ভরে দম নিল ও। ঠাণ্ডা বাতাস ঝাপটা দিল পিঠে। হাঁটা ধরন মনরো। শহরের শেষ প্রান্তে আসার পরে শুরু করুণ দৌড়। বিরামহীন তিন ঘণ্টা দৌড়াল সে। সামান্য ক্লান্ত বোধ করছে। এবার বাড়ির ফিরতি পথ ধরল মনরো। রাস্তার পাশে একটি লাঞ্চবার-এ আটকে গেল নজর। কাউন্টারের সামনে রাখা একটি টুলে বসে পড়ল সে। আরেকটা টুলে পড়ে থাকা খবরের কাগজটা তুলে নিল। পড়তে লাগল। মনোযোগে ছেদ পড়ল কাউন্টারম্যানের কন্ঠে:
‘শুনুন, মিস্টার, আমি জানি না আপনি কে রা কী, তবে আপনি যে-ই হোন, এখান থেকে উঠে পড়ন। পনেরো মিনিট আগে শর্টসার্কিট হয়ে বিদ্যুৎ চলে গেছে। অথচ অন্ধকারে বসে আপনি কিনা পেপার পড়ছেন! ফোটেন তো, মিয়া!’
কাঁধ ঝাঁকাল মনরো, চলে এল ওখান থেকে। আবার হাঁটতে লাগল রাতের বেলা এই হাঁটাহাঁটি নতুন কিছু নয়। কিছুদিন আগে, যখন ও ছিল নিতান্তই রোগা-পটকা, বেঁটে, খুদে একটা মানুষ—তখনও সান্ধ্যভ্রমণ করত মনরো। হাঁটত যাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুম আসে।
আর হাঁটাহাঁটি করতে গিয়েই লোকটার সঙ্গে ওর পরিচয়।
.
বসন্তের শেষের দিকের এক রাতের ঘটনা ছিল ওটা। মনরো হাঁটতে হাঁটতে অচেনা একটি রাস্তায় চলে এসেছে, এমন সময় ধোঁয়া চোখে পড়ল ওর। একটি বাড়ির সামান্য খোলা একটি দরজা দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ফায়ার ড্রিলের ট্রেনিং নেয়া মনরোর• চোখ প্রথমেই রাস্তায় ফায়ার অ্যালার্ম বক্স খুঁজল। তারপর পুলিশের সন্ধান করল। এরপর পথচারীর খোঁজ করল। কিন্তু কিছু বা কাউকে চোখে পড়ল না। বুক ভরে শ্বাস নিল মনরো, দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল ঘরে। বাড়িতে একটিই মাত্র ঘর। আর ধোঁয়ার পাতলা একটি রেখা উঠছে এই ঘর থেকেই। ঘরের মাঝখানে তিন ঠেঙা টেবিলের ওপর রাখা পিতলের একটি পাত্র থেকে ধোঁয়ার উৎপত্তি। ধোঁয়ার সামনে, মনরোর দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে ক্ষুদ্রকায়, বাঁকা পায়ের একটি মানুষ। তার পরনের আলখেল্লার নীচের অংশ মাটিতে লুটোচ্ছে। বেঁটে লোকটি মনরোর দিকে ফিরে তাকালও না, ইশারায় দেয়ালে ঠেস দেয়া কাউচে বসতে বলল।
কাউচের কিনারায় বসল মনরো। পিতলের পাত্র থেকে লকলকে অগ্নিশিখা জ্বলে উঠে মাঝে মাঝে আলোকিত করে তুলছে ঘর। ক্ষুদ্রকায় মানুষটির আলখেল্লার সোনার কাজ করা কারুকাজ ঝলমল করে উঠছে আলখেল্লায় চাঁদ, ছাগলসহ অচেনা ছোট ছোট কিছু জন্তুর ছবি। বেঁটে মানুষটি ঘুরল :
‘তুমি এসেছ বলে আমি খুশি হয়েছি। খুবই খুশি। ভেবেছিলাম কেউই বুঝি আসবে না।’
মনরো হাঁ করে তাকিয়ে থাকল লোকটির দিকে।
লোকটি হাত ঝাড়া দিতেই তার হাতে যেন ভোজবাজির মত উদয় হলো একটি ছোট প্যাডের কাগজ এবং পেন্সিল। সে পেন্সিলে কী যেন লিখল। তারপর বলল, ‘ভিটামিন বি। নার্ভের জন্য খুবই চমৎকার। তোমার কী কী সমস্যা আমাকে বলো।’
মনরো একটু ভেবে নিল। সে তার সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে ভালবাসে।
‘আমার খিদে বলে কিছু নেই,’ বলল সে। রাতে আমার ঘুম আসে না। আমার দাঁতের অবস্থা জঘন্য। ছেলেবেলায় একবার রিকেট হয়েছিল আমার। তারপর থেকে শরীরের হাড়গোড় তুলোর মত নরম-’
‘বেশ,’ হাতে ‘হাত ঘষল ক্ষুদ্রকায় মানুষটি। ‘তোমার লাগবে পুরো ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, সেই সঙ্গে অন্যান্য ভিটামিনেরও প্রয়োজন হবে। শুধুই ভিটামিন। কোনও তন্ত্রমন্ত্রের দরকার নেই। এখন ওং বং চং মন্ত্রের যুগ ফুরিয়েছে। ভিটামিন ক্যাপসুল খেলেই সমস্ত রোগ সেরে যাবে। আর সবগুলোই খেতে হবে। ভাগ্যিস, নিয়তি আমার কাছে তোমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে!’
ছোট্ট হাতটি থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল প্যাড, সেখানে উদয় হলো গাঢ় বাদামী রঙের একটি বোতল। বোতলটি মনরোর দিকে এগিয়ে দিল সে। মনরোকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখাল।
‘এটা নাও,’ হাসছে ক্ষুদ্র মানুষ। ‘ওষুধের দোকানে কোটি টাকা দিলেও এ জিনিস মিলবে না। অত্যন্ত উঁচুমানের ওষুধ এগুলো। মাইগড, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না কী দারুণ একটা ওষুধ তোমাকে দিচ্ছি। নাও। পয়সা দিতে হবে না। আমার তরফ থেকে তোমার জন্য এটা উপহার। তবে তোমাকে একেবারে শুধু শুধু দিচ্ছি না। একটা বিষয় প্রমাণ করা দরকার আমার। তোমাকে দিয়ে সে বিষয়টি প্রমাণ করতে চাই। ক্যাপসুল ফুরিয়ে গেলে আবার এসো। মাগনা দিয়ে দেব।’