চট করে শটগানটা নিয়ে সদর দরজা খুললেন আবরার। তবে দাঁড়িয়ে রইলেন ভেতরে, শেরিফ বা যে-ই হোক, বাইরে থেকে হামলা এলে তাকে কাভার দিতে প্রস্তুত।
উঠোনে চলে এল গাড়ি। ছোট গাড়ি, ভক্সওয়াগন, ভেতরের যাত্রী মাত্ৰ একজন-শিলা রহমান।
দ্রুত হাত নাড়তে শুরু করলেন আবরার, চলে যেতে বলছেন শিলাকে। কিন্তু শিলা ডক্টরকে দেখতে পেল না, সে তাকিয়ে আছে স্টেশন ওয়াগন আর মরা হরিণের দিকে। গাড়ি দেখে শকুনের দল অলস ভঙ্গিতে উঠে গেল লাশ ফেলে। ইঞ্জিন বন্ধ করার আগে শিলা মুখ তুলে চাঁইল দরজার দিকে, দেখতে পেল ডক্টরকে।
‘শিলা!’ গলা ছেড়ে চেঁচালেন তিনি। ‘শিগগির শহরে চলে যান। পুলিশকে খবর দিন, আর-’
চেঁচিয়ে লাভ হলো না। খুরের শব্দ শুনতে পেয়েছেন আবরার-একটা ষাঁড় প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসছে, মাত্র একশ হাত দূরে। আবরার কাছ থেকে ভক্সওয়াগনের দূরত্ব ১২ ফুট, হঠাৎ জিতে যাবার একটা সম্ভাবনা দেখতে পেলেন তিনি। যদিও কাজটা বিপজ্জনক। ষাঁড়টাকে গুলি করে ঠ্যাং খোঁড়া করে দিলে ওটা মরবে না, আর শত্রু অন্য হোস্ট নেয়ার সুযোগও পাবে না।
শিলাকে গাড়িতে থাকতে বলে এক দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি, তাক করলেন শটগান; দূরত্বটা মাপছেন, সামনের পা জোড়ায় যদি গুলি করা যায়-
আবরারের লক্ষ্য মন্দ নয়, তবে উত্তেজনার চোটে একটু তাড়াতাড়ি গুলি করে ফেললেন। ষাঁড়ের গায়ে গুলি লাগল, তবে থামল না ওটা। প্রচণ্ড রাগে উন্মাদ হয়ে উঠল আহত জানোয়ার, দিক বদল করে এবার সোজা ছুটে আসতে লাগল আবরারকে লক্ষ্য করে। মাত্র দশ হাত দূরে থাকতে দ্বিতীয় ব্যারেল বিস্ফোরিত হলো, একেবারে মোক্ষম জায়গায় লেগেছে গুলি, হৃৎপিণ্ড ফুটো করে দিয়েছে ষাঁড়ের, দড়াম করে মাটিতে আছড়ে পড়ল ওটা। আর নড়ল না।
ভক্সওয়াগনের দরজা মেলে ধরলেন ড. আবরার, ‘তাড়াতাড়ি বাড়িতে ঢুকুন, শিলা। ওটা আবার যে কোনও সময় হামলা চালিয়ে বসতে পারে। সময় নষ্ট করবেন না।’
শিলাকে নিয়ে দ্রুত দরজার দিকে এগোলেন। শটগানে গুলি নেই, আর অতিরিক্ত কার্তুজগুলো রয়ে গেছে ভেতরে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে মুখ তুলে চাইলেন তিনি। বড় একটা পাখি, শকুন নয়, উড়ে আসছে। তবে ওটা হামলা চালাতে চাইলেও দেরি হয়ে গেছে। চট করে ভেতরে ঢুকে পড়লেন তিনি, বন্ধ করে দিলেন দরজা।
দ্রুত শটগানে গুলি ভরতে ভরতে গতকাল আর আজকের ঘটনা সংক্ষেপে খুলে বললেন ডক্টর শিলাকে। ‘ইস, ডক্টর,’ বলল শিলা। ‘শেরিফকে যে কেন নিয়ে এলাম না আমার সঙ্গে! কাল বিকেলে ওঁর সাথে আমার কথা হয়েছে। আপনার কথা উনি বিশ্বাস করেননি। তবে বলেছেন আসবেন। আজ সকালে আবার কথা বলেছি। বললেন কাল সকালের আগে আসতে পারবেন না। শেরিফের কথা শুনে মনে হলো উনি ভেবেছেন পুরোটাই আমাদের কল্পনা। তাই গা ছাড়া ভাব দেখেছি তাঁর মধ্যে।’
‘কাল সকালে…’ চেহারা গম্ভীর হয়ে গেল আবরারের। এদিক ওদিক মাথা নাড়লেন। উঁহুঁ, অতক্ষণ জেগে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আর আমি যদি ঘুমিয়ে পড়ি…নাহ্, শিলা আপনার আসলে উচিত হয়নি এখানে আসা। এখন আপনিও খামোকা বিপদে জড়িয়ে পড়লেন।’
‘আমার গাড়িতে চড়ে শহরে যাবার কোন চান্স নেই? ধরুন, আমি গাড়ি চালালাম আর আপনি বন্দুক নিয়ে প্রস্তুত থাকলেন।’
‘সে চান্স একশ’ভাগের এক ভাগ, শিলা, জঙ্গলে শুধু ষাঁড় নয় প্রচুর গরুও আছে। আর শিংঅলা প্রকাণ্ড হরিণগুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম। আর বিরাট আকারের কোনও পাখি শূন্য থেকে আপনার হালকা গাড়ির ওপর আছড়ে পড়লে ওটার দফারফা হয়ে যাবে। আচ্ছা, ফিরতে দেরি দেখলে আপনার প্রতিবেশীরা খোঁজ-খবর নেবে না?’
‘মনে হয় না। কারণ প্রায়ই গ্রীনবেতে আমি সিনেমা বা নাটক দেখতে যাই, তখন এক কাজিনের বাসায় থাকি। কাজেই আজ রাতে বাসায় না ফিরলে আমার প্রতিবেশীরা ভাববে আমি গ্রীনবেতে গেছি। ইস, আমি না এসে যদি পুলিশে খবর দিতাম! বুদ্ধিটা মাথাতেই আসেনি।’
ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাত তুলে ওকে থামালেন আবরার। ‘নিজের ওপর দোষ চাপাতে হবে না। ভুলটা আমারই। দুটো ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে এখন। ধূসর বেড়ালটা মারা যাবার পর আমার এখানে রাত কাটানোই উচিত হয়নি। আর গতকাল সকালে জিম ব্রামারের মৃত্যুর ঘটনা শোনার পর জিনিসপত্র নিতে বাড়ি ফেরা মস্ত বোকামি হয়ে গেছে। আর ধরাটা তখনই খেলাম।’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।
‘চলুন, কফি খাওয়া যাক,’ বললেন আবরার। ‘এতক্ষণ শুধু ঠাণ্ডা কফি গিলেছি এখন এক কাপ গরম কফি খাওয়ার ঝুঁকি নেয়া যায়। আপনি কথা বলুন। দু’জনে মিলে একটা কিছু বুদ্ধি নিশ্চয়ই বের করা যাবে।’
কফির জন্যে পানি চড়িয়েছে শিলা, আবরার দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। বেশিরভাগ কথা তিনিই বললেন, ঘুম তাড়াতে হলে কথা বলতেই হবে। অনবরত কথা বলে গেলেন তিনি। এক পর্যায়ে শিলা রহমানকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনাকে আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি বলুন তো?’
‘এই যে আমার সাথে এ ভাবে কথা বলে আমাকে জাগিয়ে রাখবেন। আমি ঘুম তাড়াবার জন্যে হাঙ্গার স্ট্রাইক করেছি। কিন্তু আপনার খিদে লাগলে খেয়ে নিতে কসুর করবেন না। ফ্রিজ গত সন্ধ্যা থেকে চলছে না। তবে টিন বোঝাই খাবার আছে প্রচুর।’
কফি বানানো শেষ, দুটো কাপে কফি ঢেলে টেবিলে রাখল শিলা। ‘ধন্যবাদ। তবে আমার খিদে পায়নি। ভাবছি আরও দু’তিন পট কফি বানিয়ে রাখব কি না।‘