শত্রু আবার আরেক হোস্টকে ব্যবহার করেছে। সম্ভবত ইঁদুর-সেলারে ইঁদুরের অভাব নেই। ইঞ্জিন বা মোটরের তার কেটে ফেলেছে ইঁদুরকে দিয়ে। জেনারেটর চালিয়ে লাভ হবে না। শত্রু আবার ওটা নষ্ট করে দেবে।
অন্ধকার। গাঢ় অন্ধকার।
নিকষ আঁধারে ঘুম পেতে লাগল আবরারের। আর ঘুমালেই সব শেষ। একটু পরে আকাশে চাঁদ উঠল। মোট আয়তনের তিন ভাগের এক ভাগ। তবে আলোটা ঝকঝকে, আকাশ ঝলমল করছে অগুনতি তারায়। বাইরেটা দিনের আলোর মত ফকফকা, সব কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলোয় ঘরের আঁধারও অনেকখানি দূর হয়ে গেছে। লিভিং রুমটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল চোখের সামনে। হাঁটার সময় অন্তত হোঁচট খেতে হবে না আবরারকে। তাঁর একটা ফ্ল্যাশলাইট আছে, কিন্তু অতিরিক্ত ব্যাটারি থাকলেও সারারাত জ্বালিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। অল্প অল্প জ্বালাতে হবে।
কতক্ষণ জেগে থাকতে পারবেন তিনি? কাল রাতে ভাল ঘুম হয়নি, ক্লান্তও লাগছে, তারপরও আরও চব্বিশ ঘণ্টা না ঘুমিয়ে থাকতে পারবেন আবরার।
খিদে পেয়েছে। কিন্তু ডক্টর ঠিক করেছেন কিছু খাবেন না। খাবার পেটে গেলে ঘুম পেয়ে বসবে তাঁকে। ক্ষুধার্ত মানুষ খিদে নিয়ে জেগে থাকতে পারে, কারণ খিদের চোটে ঘুম পালাতে বাধ্য।
পায়চারি শুরু করলেন আবরার। পাল্টা হামলা করার কথা ভাবছেন। কিন্তু কীভাবে?
যে শত্রুর চেহারাই তিনি এখন পর্যন্ত দেখেননি তাকে আঘাত করবেন কীভাবে? ওটা কি অদৃশ্য নাকি ওকে দেখা যায়? শরীর আছে? তাঁর মনে হচ্ছে এ বাড়ির কোথাও লুকিয়ে আছে শত্রু। কাল সকাল বেলা শত্রু নিধন অভিযানে নেমে পড়বেন তিনি, জীবিত কিছু চোখে পড়া মাত্র গুলি করবেন।
লম্বা, দীর্ঘতম রাতটার এক সময় অবসান ঘটল। ফুটল ভোরের আলো। আবরার নেমে পড়লেন শত্রুর খোঁজে। প্রতিটি ঘর, বেযমেন্ট কিছুই বাদ দিলেন না। তিনি জানেন না আসলে কী খুঁজছেন, ওটা ছোট না বড় কিছুই জানা নেই তাঁর। বেযমেন্টে গিয়ে দেখলেন জেনারেটরের তার কাটা। শত্রু ইঁদুর টিদুর দিয়ে কাজটা করিয়েছে। ঠিক করে লাভ হবে কোনও? তিনি ওপরে যাওয়া মাত্র কাউকে দিয়ে আবার তার কেটে দেয়া হবে।
হঠাৎ ছাদের দিকে তাকাতে বুক ধক্ করে উঠল। একটা মথ উড়ছে ওখানে। শত্রু মথের ছদ্মবেশে তার ওপর নজরদারী করছে না তো?
স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন আবরার, স্টোর রুমে ঢুকে বন্ধ করে দিলেন দরজা। দ্রুত নেমে পড়লেন কাজে। কোট হ্যাঙার বাঁকিয়ে, স্লিপিংব্যাগ ছিঁড়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রজাপতি ধরার জাল বানিয়ে ফেললেন। খুবই বাজে এবং হাস্যকর দেখতে হলো জিনিসটা। তবে কাজ চলে যাবে।
মথটা এখনও ছাদের নীচে উড়ে বেড়াচ্ছে। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর ফাঁদে আটকানো গেল ওটাকে। তারপর সাবধানে পতঙ্গটাকে একটা খালি দেশলাই বক্সের মধ্যে ঢোকালেন আবরার। মথটা খুব সহজে মরবে না, এর মধ্যে এখান থেকে তিনি পালাতে পারবেন। অবশ্য মথটা যদি সত্যি-
শটগান নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লেন ডক্টর। চারপাশে নজর বুলালেন। ভীতিকর কিছু চোখে পড়ল না। আকাশেও কোনও পাখি উড়তে দেখা যাচ্ছে না।
গভীর দম নিলেন আবরার, হাঁটা শুরু করলেন। মাত্র দশ কদম এগিয়েছেন, হঠাৎ মাথার ওপর পতপত শব্দ হতে ‘মুখ তুলে চাইলেন। বুক হিম হয়ে গেল বিশাল আকারের একটা চিকেন হককে তাঁকে ঘিরে বৃত্তাকারে উড়তে দেখে। ওটা আবরারকে লক্ষ্য করে ডাইভ দিল, হত্যার উদ্দেশে নয়, ভয় দেখিয়ে ঘরে ফেরাতে।
ভয়ঙ্কর মিসাইলের মত ছুটে আসছে চিকেন হক, আবরারের কাছ থেকে যখন আট/দশ হাত দূরে, ডক্টরের হাতের শটগান গর্জে উঠল বিকট শব্দে। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল পাখিটা শক্তিশালী বুলেটের আঘাতে। রক্ত আর পালক লাগল আবরারের মুখে। তাঁর কাছ থেকে দু’হাত দূরে এসে ছিটকে পড়ল ওটা।
দৌড়ে ঘরে ঢুকে পড়লেন ডক্টর। মুখ ধুলেন, পোশাক ঠিকঠাক করে কিচেনে ঢুকলেন। দেশলাইয়ের বাক্স খুলে মথটাকে বের করলেন আবরার, ছেড়ে দিলেন। ভুল ভেবেছেন তিনি। ওটা স্রেফ সাধারণ একটা মথ, তার শত্রুর হোস্ট নয়। তাঁর পরিকল্পনাটা ভালই ছিল, কিন্তু শত্রু তাঁকে কোনও সুযোগ দিতে রাজি নয়।
বিশ
কিছুই ঘটল না।
মিনিটগুলো যেন ঘণ্টা। গত চব্বিশ ঘণ্টায় ড. আবরার অল্পক্ষণ মাত্র ঘুমাতে পেরেছেন। বেশিরভাগ সময় পায়চারি করে কাটিয়ে দিচ্ছেন এই জানালা থেকে ওই জানালায়, শূন্য দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন বাইরে। পা দুটো ব্যথায় বিষ হয়ে গেছে, আরাম করে বসার সাহস পর্যন্ত পাচ্ছেন না। যদি ঘুমিয়ে পড়েন! প্রায়ই কফি পান করছেন, তবে এখন ঠাণ্ডা খাচ্ছেন, ঠাণ্ডা কফিতে ঘুম কম আসে।
সকাল হয়েছে। তবে বড় ধীর গতিতে বয়ে যাচ্ছে সময়। আবরার আশায় আছেন শেরিফ অথবা স্টেট পুলিশ এসে পড়বে, না হলে শিলা তো আসবেই। সে হয়তো বুঝতে পারবে আবরার বিপদে পড়েছেন। না হলে মিস শিলার সাথে তিনি দেখা করতেন।
আর বেশিক্ষণ হয়তো জেগে থাকা সম্ভব হবে না। আগে সোফার হাতলে একটু বসতেন, এখন তাও সাহস হচ্ছে না। বার বার বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে চোখ, জোর করে মেলে রাখতে হচ্ছে। পাইপ টানতে টানতে তেতো হয়ে গেছে মুখ। এ মুহূর্তে ঘুম তাড়ানোর মহৌষধ বেনজেড্রিন ট্যাবলেট বড় দরকার ছিল। কিন্তু সাথে আনেননি তিনি। ছুটি কাটাতে এসে কি কেউ ঘুম তাড়াবার ওষুধ খায়? সকাল গড়িয়ে দুপুর আসছে, জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ডক্টর, তবে কাঁচের গায়ে মাথা ঠেকাতেও সাহস পাঁচ্ছে না। হঠাৎ গাড়ির শব্দ শুনতে পেলেন।