দৃশ্যটা ভয়ঙ্কর: দুজন মানুষ, বারো ফুট লম্বা এক দেবতা, মাটির নীচে এক অন্ধকার ঘরে পরস্পরের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে। সার রোনাল্ডের ঠোঁট নড়তে শুরু করল। প্রাচীন মিসরীয় স্তোত্র পাঠ করছেন। অ্যানুবিসের কপালে আলো জ্বলজ্বল করছে, সেদিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন তিনি। আস্তে আস্তে তাঁর দৃষ্টি চকচকে হয়ে এলং চোখে পলক পড়ছে না, তারায় ফুটে উঠল অদ্ভুত এক নিষ্প্রাণ জ্যোতি। হঠাৎ তাঁর শরীর একদিকে নুয়ে পড়ল, যেন পৈশাচিকভাবে সমস্ত শক্তি কেড়ে নেয়া হয়েছে। আতঙ্কিত পিটার দেখল তার বাবার চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেছে, তিনি হাঁটু ভেঙে পড়ে গেলেন মেঝের ওপর। কিন্তু দেবতার চোখ থেকে একবারও দৃষ্টি ফেরালেন না। এভাবে কেটে গেল বেশ ক’টি মুহূর্ত। মশাল উঁচিয়ে রাখতে রাখতে পিটারের বাঁ হাতে ঝিঁঝি ধরে গেল।
পিটার কিছু ভাবতে পারছে না। তার বাবাকে এর আগেও বহুবার আত্মসম্মোহন করতে দেখেছে সে আয়না আর আলো নিয়ে। কিন্তু বদ্ধ ঘরে বিপদের কোনও আশঙ্কা ছিল না। আর এখানকার অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাবা কি পারবেন মিসরীয় এই দেবতার শরীরে প্রবেশ করতে? যদি পারেনই তা হলে ওই অভিশাপ? প্রশ্ন দুটো বার বার আলোড়িত হতে থাকে পিটারের মনে। কিন্তু কোনও জবাব পায় না। হঠাৎ ব্যাপারটা লক্ষ করল সে। প্রচণ্ড ভয়ে যেন জমে গেল। ওর বাবার চোখে মরা মানুষের শেষ চাউনি, সচেতন ভাবটা সম্পূর্ণ উধাও। কিন্তু দেবতার চোখ- অ্যানুবিসের দৃষ্টি এখন আর নিষ্প্রাণ এবং পাথুরে নয়। ভয়ঙ্কর মূর্তিটা জেগে উঠেছে! ওর বাবা তা হলে ঠিকই বলেছিলেন। কাজটা করেছেন তিনি-সম্মোহনের মাধ্যমে নিজের সচেতনতাবোধ মূর্তির মধ্যে প্রবেশ করিয়েছেন। কিন্তু এখন? এরপর কী ঘটবে? বাবা বলেছিলেন তাঁর আত্মা সরাসরি সমাধিস্তম্ভে প্রবেশের পথ খুলে দেবে। কই, সেরকম তো কিছুই ঘটছে না। কারণ কী?
শঙ্কিত এবং ভীত পিটার উবু হয়ে পরীক্ষা করল সার রোনাল্ডের শরীর, নিস্তেজ, নিষ্প্রাণ একটা শরীর। মারা গেছেন সার রোনাল্ড বার্টন। ঝট করে পিটারের মনে পড়ল পার্চমেন্টের সেই ভয়ঙ্কর সাবধানবাণী:
যারা বিশ্বাস করবে না তারা মরবে। প্রভু অ্যানুবিসকে পাশ কাটিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়া হয়তো সম্ভব হবে, কিন্তু তিনি আর অনুপ্রবেশকারীকে বাইরের পৃথিবীতে ফেরত যেতে দেবেন না। মনে রেখ, অ্যানুবিস এক অদ্ভুত দেবতা যার মধ্যে রয়েছে এক গোপন আত্মা।
গোপন আত্মা! কেঁপে উঠল পিটার। মশালটা উঁচিয়ে ধরে সোজা শেয়াল দেবতার চোখের দিকে চাইল। অ্যানুবিসের ঠাণ্ডা পাথুরে চোখ দুটো জ্যান্ত!
পৈশাচিকভাবে জ্বলজ্বল করছে অশুভ দেবতার দুই চোখ। ওদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই যেন উন্মাদ হয়ে গেল পিটার। ওর মাথা শূন্য হয়ে গেছে। কিছুই ভাবতে পারছে না। তার মাথায় দড়াম দড়াম বাড়ি খাচ্ছে শুধু একটাই ব্যাপার-তার বাবা মারা গেছেন। আর এই মৃত্যুর জন্য দায়ী এই মূর্তিটা। যেভাবেই হোক বাবাকে হত্যা করে সে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বিকট চিৎকার দিয়ে সামনের দিকে ছুটে গেল পিটার বার্টন, দমাদম ঘুসি মারতে লাগল পাথরের মূর্তির বুকে। হাত ফেটে রক্ত বেরুতে শুরু করল, রক্তাক্ত মুঠিতে চেপে ধরল সে অ্যানুবিসের শীতল দুই পা, টানতে লাগল। যেন উল্টে ফেলবে। কিন্তু এক চুল নড়ল না দানব-মূর্তি। বিকট চোখে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। অশ্রাব্য গালিগালাজ শুরু করল পিটার। বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে ওকে। কী করছে নিজেও জানে না। মূর্তিটা যেন ওর দুর্দশা দেখে আনন্দ পাচ্ছে, ভেঙচি কাটছে। পাগলের মত ওটার গা বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল পিটার। থেকে থেকে ঝাঁকি খাচ্ছে ওর শরীর, ফোঁপাচ্ছে, বাবার কথা বলছে ফোঁপাতে ফোঁপাতে। চোখে খুনের নেশা। যেন ভেঙচি কাটা মুখটাকে ধ্বংস করে দেবে।
অ্যানুবিসের মাথার কাছে পৌঁছুতে কত সময় লেগেছে জানে না পিটার। হঠাৎ ওর সম্বিত ফিরে এল। লক্ষ করল মূর্তিটার ঘাড়ের কাছে চলে এসেছে। পা ঝুলছে মূর্তির পেটের কাছে। উন্মাদ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ভয়ঙ্কর এবং জ্যান্ত চোখ দুটোর দিকে।
হঠাৎ গোটা মুখটা যেন বেঁকে যেতে শুরু করল। ফাঁক হয়ে গেল পাথুরে ঠোঁট, বিশাল এক গহ্বরের সৃষ্টি হলো মুখে, নড়ে উঠল হাত। লম্বা, প্রসারিত হাত দুটোর আঙুলগুলো বাঁকানো, যেন ছোবল দেবে কালনাগিনী। বিদ্যদ্বেগে হাত দুটো পিটারকে শক্ত, পাথুরে বুকের সঙ্গে মরণ আলিঙ্গনে বেঁধে ফেলল, পরক্ষণে আঙুলগুলো চেপে বসল ওর গলায়। হাঁ করা মুখটা নেমে এল নীচে, ধারাল দাঁতে কামড় বসাল পিটারের ঘাড়ে। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসা উষ্ণ রক্ত ভিজিয়ে দিল প্রতিহিংসায় উল্লসিত ত্রিশ হাজার বছরের পুরোনো অশুভ দেবতার মুখ।
.
পরদিন স্থানীয় লোকেরা পিটারের রক্তশূন্য, হাড়গোড় ভাঙা লাশটা আবিষ্কার করল অ্যানুবিসের পায়ের নীচে। সার রোনাল্ডের প্রাণহীন দেহটাও তার পাশে চিৎ হয়ে আছে। দেবতার অভিশাপের ভয়ে সমাধিতে ঢোকার সাহস কারও হলো না। বরং দরজা বন্ধ করে যে যার বাড়ি ফিরে গেল। তারা বলল বুড়ো এবং তরুণকে ‘ইফেন্দি’ হত্যা করেছে। আর এই মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল। কারণ দেবতা অ্যানুবিস অনুপ্রবেশকারীদের সহ্য করেন না।
সবাই চলে যাবার পর আবার কবরের নিস্তব্ধতা এবং অমাবস্যার কালো অন্ধকার নেমে এল পাতাল ঘরটিতে। স্থানীয়রা এখান থেকে চলে যাবার আগে দেখে গেছে অ্যানুবিসের নিষ্প্রাণ পাথুরে মূর্তির চোখে জীবনের কোনও আভাস নেই। কিন্তু মৃত্যুর আগে পিটার বার্টন যা জেনে গেছে তা কেউ জানতে পারেনি, কোনওদিন জানবেও না। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে পিটার দেখেছে অ্যানুবিসের পৈশাচিক পাথুরে চোখের জায়গায় ছলছল করছে ওর বাবার দুই চোখ!