চিন্তিত ভঙ্গিতে বাড়িতে ঢুকলেন ডক্টর, বন্ধ করে দিলেন দরজা। না, শত্রু তাকে হত্যা করতে চায় না, এখানে বন্দী করে রাখতে চায়। ওয়াইল্ড ডাকটা তাঁকে ইচ্ছে করে মিস করেছে। শত্রু বুঝিয়ে দিল বাইরে গেলে কী দশা হবে তার।
শটগানের ওপরের ব্যারেল রিলোড করে অস্ত্রটা সদর দরজার পাশের জানালার সাথে হেলান দিয়ে রাখলেন আবরার। পকেট খালি করে অতিরিক্ত শেল আর কার্তুজগুলো সোফায়, হাতের নাগালে রেখে দিলেন। তারপর সোফার হাতলে বসে তাকিয়ে রইলেন জানালা দিয়ে।
জীবনের কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না বাইরে। তা হলে কি সবই তাঁর কল্পনা? তিনি কি পায়ে হেঁটে রওয়ানা হবেন শহরের উদ্দেশে? নাহ্, তা উচিত হবে না। হরিণ আর ওয়াইল্ড ডাকের চেহারা ভেসে উঠল চোখে।
আচ্ছা, তার শত্রুর প্রকৃতি কী? ওটা কি মানুষ, দানব নাকি ভিনগ্রহবাসী? হয়তো শেষেরটাই ঠিক।
শিলা বলেছিল না পৃথিবী ছাড়াও ব্রহ্মাণ্ডের কোটি কোটি গ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণী বাস করতে পারে।
কিন্তু ভিনগ্রহবাসীর তাঁর ওপর এত আক্রোশ কেন? এর কারণ কি এই-তিনি তার শত্রুর যে সব তথ্য জেনে গেছেন বা সন্দেহ করেছেন সেটা ভিনগ্রহবাসীর অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলতে পারে? হ্যাঁ, তাই হবে।
তাঁর ধূসর বেড়ালটার কথা মনে পড়ল। বেড়ালটা বন্দী অবস্থায় তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ করেছে। শিলার সাথে তাঁর আলাপচারিতা, স্টেটমেন্টের বিষয় কোনকিছুই হয়তো তার অজানা নেই। শত্রু তাঁকে বিপজ্জনক বলে ধরে নিয়েছে। তবে তাঁকে মারার সুযোগ পেয়েও সে মারেনি, বাঁচিয়ে রাখতে চায়। কোথাও যেতেও দিচ্ছে না। এখানেই আটকে রাখতে চায় সে। কিন্তু কেন?
তা হলে কি সে আবরারকে হোস্ট বানাতে চায়? হতে পারে। কিন্তু আগে কেন হোস্ট বানায়নি। এখন চাইছে কেন?
বাইরের পরিবেশ একেবারে শান্ত। আবরার রান্নাঘরে ঢুকে স্টোভে পানি বসালেন। কফি বানাবেন। তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তাকে হোস্ট বানাবার জন্য শত্রুর কি বিশেষ কোনও প্রস্তুতি দরকার?
হঠাৎ প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেলেন তিনি। ব্যাপারটা নিয়ে যত মাথা খেলালেন ততই পরিষ্কার হয়ে এল বিষয়টা, রনিকে হোস্ট বানানো হয়েছে ঘুমের মধ্যে। একই কাণ্ড ঘটেছে হেলমুট কোহলের ক্ষেত্রেও। জিম ব্রামারও নিশ্চয়ই ঘুমের মধ্যে অজানা শত্রুর শিকার হয়েছে। আর জানোয়ার হোস্টগুলো বিশেষ করে কুকুর এবং বেড়ালরা এরা তো দিনে-রাতে যখন- তখন ঘুমিয়ে পড়ে।
কিন্তু শত্রু যদি তাকে হোস্ট বানাতে চায় তা হলে কাল রাতে ভর করল না কেন? হতে পারে, কাল রাতে আবরারের ভাল ঘুম হয়নি, একটু ঘুমিয়েছেন; আবার জেগে উঠেছেন। আবার এমনও হতে পারে জেমস ব্রামারকে হোস্ট বানাবার কাজে তাঁর শত্রু ব্যস্ত ছিল বলে এদিকে নজর দিতে পারেনি। তবে এ থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে আসে। আর তা হলো—শত্রু দু’জন নয়, একজন এবং সে একবারে একজনকেই হোস্ট করার ক্ষমতা রাখে। তবে ব্যাপারটা সম্পর্কে যদি নিশ্চিত হওয়া যেত-
ডক্টর হঠাৎ শটগান নিয়ে দরজা খুললেন, সতর্ক ভঙ্গিতে কয়েক পা বাড়ালেন সামনে, তাকালেন ওপরের দিকে।
পাখি, বড় বড় পাখি, ছ’সাতটা হবে, আকাশে পাক খাচ্ছে। তা হলে কি ডক্টরের ধারণা ভুল?
পরক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে। ওগুলো অদৃশ্য শত্রুর হোস্ট নয়, কতগুলো শকুন, মৃত হরিণের লোভে এসেছে। একেবারে সাধারণ পাখি। শকুন দেখে এত আনন্দ কখনও হয়নি আবরারের, এখন যেমন আনন্দ হচ্ছে।
হঠাৎ জঙ্গলের ভেতর থেকে আরেকটা পাখি উড়ে আসতে দেখলেন তিনি, মনে হলো বুনো হাঁস। পাখিটা অনেক উঁচুতে উঠে গেল, তারপর ডাইভ দিল ডক্টরকে লক্ষ্য করে। তিনি গুলি করতে পারতেন, কিন্তু বেশি ঝুঁকি হয়ে যায় উপলব্ধি করে চট করে পিছিয়ে এলেন, বন্ধ করে দিলেন দরজা। এক সেকেন্ড পর বিকট শব্দে পাখিটা আছড়ে পড়ল বারান্দায়। চেহারা অন্ধকার হয়ে গেল আবরারের। বাইরে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয় বুঝতে পেরেছেন। তবে তাঁর শত্রুর একটি সীমাবদ্ধতার কথাও জেনে ফেলেছেন। শত্রু শুধু ঘুমন্ত প্রাণীদেরকেই কব্জা করতে পারে, জেগে থাকা কাউকে নয়। আর ওটাকে ঘুমন্ত প্রাণী, খুঁজে বের করতে হয়। এতেও নিশ্চয়ই সময় নষ্ট হয়।
ভয়ঙ্কর এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাবার সম্ভাবনা যে একেবারে নেই, তা নয়। আশার কথা, শিলা জানে তিনি তার সাথে দেখা করবেন। যথাসময়ে তাঁর দেখা না পেলে সে নিশ্চয়ই চিন্তিত হয়ে ফোন করবে শেরিফকে। শেরিফ হয়তো খবর পেয়ে আসবেন। তাঁকে যদি অদৃশ্য শত্ৰুটা মেরেও ফেলে, তাঁর লোকবল আছে অনেক। সশস্ত্র লোকগুলোর বিরুদ্ধে ক’টা প্রতিরোধ পাঠাবে শত্রু? শেষ পর্যন্ত ওদেরই জয় হবে।
হ্যাঁ, সাহায্য আসবে। তবে ডক্টর আবরারের কাজ কাজ এখন একটাই—কিছুতেই ঘুমিয়ে পড়া চলবে না।
উনিশ
এ যেন অনন্ত সময়, সীমাহীন, স্থির, `কাটতে চায় না কিছুতেই। তবু প্রাকৃতিক নিয়মে দিন গড়িয়ে রাত এল, এল ঘুমাবার সময়। ডক্টর আবরার সারা বাড়ি ঘুরছেন, ওপরে যাচ্ছেন, নীচে যাচ্ছেন, আলো জ্বালছেন, নিভাচ্ছেন, অস্থির লাগছে তাঁকে।
হঠাৎ সবগুলো আলো নিভে গেল একসাথে। জেনারেটর? হ্যাঁ, জেনারেটরের কারণেই বাতি নিভে গেছে। কিন্তু গ্যাসোলিন মটরে যে পরিমাণ ফুয়েল আছে তা দিয়ে আরও কয়েকদিন হেসে খেলে চলার কথা। হয় জেনারেটর নতুবা মোটর, দুটোর যে কোনও একটা নষ্ট হয়ে গেছে।