অসুবিধে নেই, আবরার বাড়ি ফিরেছে। এখন হোক আর পরে হোক, নিশ্চয়ই সে ঘুমাবে। তারপর সে কী সন্দেহ করেছে তাতে কিছু আসবে যাবে না।
কিন্তু আবরার এটা কী করছে? সে স্টোররুম থেকে সুটকেস বের করে দোতলায় যাচ্ছে কেন? সুটকেসে জামা-কাপড়সহ নিত্য-ব্যবহার্য সমস্ত জিনিসপত্র ঢোকাচ্ছে। তার মানে এখান থেকেও চিরতরে চলে যাবার পরিকল্পনা করেছে।
উঁহু, এ কিছুতেই হতে দেয়া যায় না। তাকে যেভাবেই হোক ঠেকাতে হবে।
.
ড. আবরার সুটকেস দুটো এনে স্টেশন ওয়াগনের পেছনে রাখলেন। তারপর আবার বাড়িতে ঢুকলেন। দ্রুত একবার চক্কর দিলেন সারা বাড়ি, দরজা- জানালা বন্ধ করলেন। রান্নাঘরে ঢুকে ইতস্তত করলেন সুইচ অফ করবেন কিনা। তা হলে বেযমেন্টের গ্যাসোলিন ইঞ্জিন এবং জেনারেটর বন্ধ হয়ে যাবে। যাক, বন্ধ করার দরকার নেই। ফ্রিজে খাবার আছে। নষ্ট হয়ে যাবে। তিনি আবার আসবেন। তবে একা অবশ্যই নয়।
ফিশিং ইকুইপমেন্ট, পিস্তল বন্দুক ইত্যাদি নিয়ে স্টেশন ওয়াগনে উঠে বসলেন আবরার। স্টার্ট দিলেন ইঞ্জিন। ঠিক তখন ওটাকে চোখে পড়ল তাঁর।
একটা হরিণ। বিশালদেহী। গাড়ি থেকে পঞ্চাশ হাত দূরে, জঙ্গলের কিনারে, যেখান থেকে তার বাড়ির সীমানা শেষ এবং রাস্তার শুরু, ঠিক সেখানটায়। কটমট করে তাকিয়ে আছে হরিণটা আবরারের দিকে। তারপর নিচু করল মাথা, খুর দিয়ে ধুলো ওড়াল, হামলার জন্য প্রস্তুত।
ওটা কী করতে যাচ্ছে বুঝে ফেললেন ডক্টর। দ্রুত গিয়ার দিলেন তিনি 1 তাঁর ইচ্ছে হরিণটাকে পাশ কাটিয়ে যাবেন। কিন্তু সে সুযোগ তাঁকে দিল না হরিণ। গাড়ি চলতে শুরু করেছে, ওটাও শিং বাগিয়ে তেড়ে এল। গাড়ি পিছিয়ে আনার সুযোগও পেলেন না আবরার। দুশো পাউন্ড ওজনের শরীর নিয়ে চলন্ত মিসাইলের মত হরিণটা গোত্তা খেল রেডিয়টরের কেন্দ্রে, দুই হেডলাইটের মাঝখানে। প্রচণ্ড সংঘর্ষে খুলি ফেটে চুরচুর হয়ে গেল হরিণের, ঘাড় ভেঙে মাটিতে পড়ে গেল লাশ হয়ে। ভয়ানক ঝাঁকি খেলেন আবরার, ড্যাশবোর্ডের সাথে ভীষণভাবে ঠুকে গেল মাথা, চোখের সামনে জ্বলে উঠল লাল-নীল হরেক রঙের তারা।
থেমে গেছে ইঞ্জিন। আবরার ইগনিশন অফ করলেন, আবার স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থাকলেন। জানেন এ গাড়ি গ্যারেজে না নিয়ে গেলে আর চলবে না।
তাঁর কাছে অস্ত্র আছে .২২ বোরের রাইফেল, পিস্তল আর শটগান। এ নিয়ে পায়ে হেঁটে শহরে যাবার ঝুঁকি নেয়া সম্ভব নয়। এক পাল জানোয়ার যদি তাঁর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয়, কী করতে পারবেন তিনি? মাঠ বা আল ধরে যাবার উপায় নেই। ওখানে ষাঁড় আর গরুর দল ঘাস খাচ্ছে। আর জঙ্গলের মধ্য দিয়েও যাবার প্রশ্ন নেই। ওখানে প্রচুর হরিণ আছে। একটা দুটো ভালুক বা ওয়াইল্ড ক্যাট থাকাও বিচিত্র নয়। এগুলোর চেয়েও ভয়াবহ বিপদ আসতে পারে তাঁর শত্রু যদি ভাত-ঘুম দেয়া কোনও লোকের ওপর ভর করে বসে। যদি মিসেস কোহ্ বা মিসেস ব্রামার শটগান বা রাইফেল নিয়ে হাজির হয়ে যায়, তাঁকে গুলি করতে শুরু করে তখন? উল্টো তিনিও কি গুলি করবেন? মহিলাদের গায়ে হাত তুলতে পারবেন না, ভাল করেই জানেন আবরার, আর রাস্তায় হেঁটে গেলে জানোয়ার বা মানুষ যে-ই আসুক, কতজনকে হত্যা করবেন তিনি? কেউ না কেউ তাঁকে ঠিকই পেড়ে ফেলবে। তাঁর অজানা শত্রু একের পর এক হামলাকারীকে পাঠাবে। সবাইকে সামাল দেয়া কিছুতেই সম্ভব হবে না তাঁর পক্ষে।
তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেছে-ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসান ঘটেছে। তাঁর শত্রু-ওটা যাই হোক-আর ভান করার প্রয়োজন বোধ করছে না। ওটা ড. আবরারকে এখানে আটকে রাখতে চাইছে, হয়তো সফলও হবে। পেছনের সিটে হাত বাড়িয়ে শটগান আর পিস্তল তুলে নিলেন ডক্টর। লোড করে রাখলেন।
অদ্ভুতই বলতে হবে, তাঁর একটুও ভয় করছে না, আগের চেয়ে অনেক শান্ত লাগছে নিজেকে। এ যুদ্ধে জিততে হলে উত্তেজিত হওয়া বা মাথা গরম করা চলবে না। এ যুদ্ধে প্রধান অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগাতে হবে মনের শক্তি। ফায়ার আর্মস দিয়ে লড়াই জেতা যায়, যুদ্ধ নয়।
প্রথম প্রশ্ন হলো- সারভাইভাল। তিনি এখানে বেশি নিরাপদ থাকবেন নাকি বাড়িতে? হয়তো বাড়িতে। শত্রু চায় না তাঁর কাছে কোনও সাহায্য আসুক। আচ্ছা, তিনি যদি চুপচাপ বসে থাকেন এবং পালাবার চেষ্টা না করেন তা হলেও কি তাঁর শত্রু তাঁকে খুন করবে? মনে হয় না। শত্রু চাইলে অনেক আগেই তিনি মরে ভূত হয়ে যেতেন। গাড়িতে ওঠার আগেই হরিণটা তাঁকে শুঁড়িয়ে দফারফা করে দিতে পারত। তিনি তো ওটাকে আগে লক্ষই করেননি।
ডক্টর আবরার সিদ্ধান্ত নিলেন বাড়িতে ঢুকবেন তিনি। পিস্তল পকেটে রেখে, শটগান রেডি করে সাবধানে গাড়ি থেকে নামলেন তিনি। চারপাশে সতর্ক নজর বোলালেন। জ্যান্ত কিছু দেখা যাচ্ছে না।
তবে-
মুখ তুলে আকাশের দিকে চাইলেন আবরার। একশ’ ফুট উঁচুতে বাতাসে ধীর গতিতে বৃত্ত রচনা করে উড়ছে একটা ওয়াইল্ড ডাক। বুনো হাঁস ওভাবে ওড়ে না। তার মানে কি পরবর্তী হামলা আসছে আকাশ থেকে? এটা তো আরও বিপজ্জনক। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় শূন্য থেকে মিসাইলের মত কোনও শক্তিশালী, ওজনদার পাখি যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘাড়ের ওপর তা হলে আর দেখতে হবে না।
আবরার বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছেন, ‘ডাইভ দিল ওয়াইল্ড ডাক। ঝট করে বন্দুক তুললেন ডক্টর, দ্রুত সরে গেলেন এক পাশে। না, পাখিটা তাঁর ওপর হামলা করার জন্য ডাইভ দেয়নি। তাঁর কাছ থেকে হাত দশেক দূরে, মাটিতে আছড়ে পড়ল ধুলোর মেঘ উড়িয়ে।