আজ বিষ্যুদবার। শিলা অপেক্ষা করছিল ডক্টরের জন্যে। তাঁর গাড়ির আওয়াজ শুনেই দরজা খুলে দিল।
‘আসুন, ডক্টর। সব রেডিই আছে। বসুন, আমি নোটবই আর ম্যানুস্ক্রিপ্ট নিয়ে আসছি।’
‘ধন্যবাদ, মিস শিলা। তবে আমার বন্ধুদের যে চিঠি লেখার কথা বলেছিলাম আজ জার আপনাকে দিয়ে তা লেখাব না। চিঠি এবং স্টেটমেন্ট পাঠাবার আগে আরও দু’একটা দিন একটু ভেবে নিই। এর মধ্যে কোনও ঘটনা ঘটলে ওর মধ্যে যোগ করতে পারব।’
ঠিক আছে। আপনার যেমন ইচ্ছা,’ একটা বড়, বাদামী খাম এগিয়ে দিল শিলা আবরারকে। ‘পড়ে শোনাব এখন?’
মাথা নাড়লেন আবরার। ‘বাসায় বসে পড়ব। আপনার সময় থাকলে বরং দু’চারটে কথা বলি।’
শিলা রহমানের সময় আছে। ডক্টর বেড়ালটার কথা বললেন ওকে। ‘ওটাকে নিয়ে যে ভয় কাজ করছিল মনে তা অনেকটাই কেটে গেছে,’ হাসলেন তিনি। ‘আসলে আপনার ভূতে ধরা বা ওই ধরনের কথা শুনে আমার মনেও ভয় ধরে গিয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে বেড়ালটাকে ভয় পাবার কিছু নেই। নিতান্তই সাধারণ একটা বেড়াল ওটা, মিস শিলা।’
‘আর টাইগারও সাধারণ একটা কুকুর ছিল, অন্তত আপনার গাড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত। তবে আপনি যা-ই বলুন, ডক্টর, আমি কিন্তু পুরোপুরি দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারছি না। ব্যাপারটা যদিও হাস্যকর শোনাচ্ছে- কিন্তু আপনাকে নিয়ে আমি চিন্তায় আছি।’
‘আমার কিছু হবে না, মিস শিলা। আসলে আমরা দু’জনেই ব্যাপারটাকে অতিরঞ্জিত করে ফেলেছি।
‘হয়তো ডক্টর…আপনি চিঠি আর রিপোর্টগুলো আপনার বন্ধুদের পাঠাবেন তো?’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আবরার। ‘আচ্ছা, পাঠাব। তবে ক’টা দিন সময় দিন।
‘আচ্ছা, সময় নিন। আমি এ হপ্তাটা বাড়িতেই আছি। কাজেই যে কোনও সময় এলেই আমাকে পাবেন।
সে রাতে, খাওয়া-দাওয়া শেষে, লিভিংরুমের সোফায় এসে বসেছেন আবরার, বেড়ালটা তাঁর পাশে বসল। তিনি ওর নরম, রেশমি লোমে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আরামে গরগর করল বেড়াল।
‘তারপর, খবর কী তোমার, বিল্লি?’ বললেন তিনি। ‘ভাল লাগছে এখানে থাকতে? পছন্দ হচ্ছে আমাকে? বন্দী বন্দী লাগছে না তো? ঠিক আছে তোমাকে আমি কাল-পরশুর মধ্যে একবার বাইরে যেতে দেব। এখন আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দাও দেখি।’
উঠে দাঁড়ালেন আবরার, একটা চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসলেন বেড়ালটার। আবার শুরু করলেন, ‘বিল্লি, তুমি লুকিয়েছিলে কেন? দোতলার জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকেছ কেন? জান না, বেড়ালরা অমন কাজ করে না, এখনকার মত স্বাভাবিক আচরণ কেন করনি তুমি আগে?’
থাবা দুটো টানটান করল বেড়াল, তারপর আবার কুণ্ডলী পাকিয়ে বন্ধ করল চোখ।
‘বিল্লি,’ কঠিন গলায় তাকালেন আবরার। চোখ খুলে গেল ওটার, তাকাল ডক্টরের দিকে।
‘বিল্লি, আমি কথা বলার সময় ঘুমানো চলবে না, তুমি তো কোলদের প্রতিবেশীদের বাড়িতে থাকতে। জানো, হেলমুট যেদিন আত্মহত্যা করেছে, সে রাতে তাদের একটা বেড়ালও একই কাজ করেছে? সোজা একটা হিংস কুকুরের মুখে গিয়ে পড়েছে। কিন্তু কেন আত্মহত্যা করবে?’
বেড়ালটা আবার চোখ বুজল, তবে আবরারের মনে হলো ঘুমায়নি ওটা।
‘একই রাতে একটা পেঁচাও আত্মহত্যা করেছে, সে কথা জানো? তার আগে রনি মারা গেল, মারা গেল ওদের কুকুরটাও, আমারই গাড়ির নীচে চাপা পড়ে। কুকুরটা লুকিয়ে ছিল রাস্তার পাশে, আমার গাড়ি লক্ষ্য করে লাফ দিয়েছে। ইচ্ছে করে।
‘দুটো মানুষ। চারটে প্রাণী-এরা সবাই আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু কেন? নাকি ওদের আত্মহত্যায় বাধ্য করা হয়েছে কারও স্বার্থ হাসিল হবার পর? কেউ কি ওদের ব্যবহার করেছে?’
বাইরে হাজার হাজার ঝিঁঝিঁ ডাকছে, জানালা দিয়ে তাকালেন আবরার। নিকষ অন্ধকার। তার মনে পড়ছে লেমিংদের কথা। এরা দল বেঁধে সাগরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। ওরা কি সবাই পাগল? নাকি লেমিংরা এমন কিছু জানে যার কথা আমরা জানি না। তিনি আবার ঘুরলেন বেড়ালের দিকে
‘বিল্লি, ওই প্রাণীগুলো কেন আত্মহত্যা করেছে, বলো তো? তুমি যদি ওদের একজন হও তা হলে তুমি কেন কাজটা করছ না? নাকি এখানে বদ্ধ অবস্থায় থেকে আত্মহত্যার সুযোগ পাচ্ছ না? ঠিক আছে, ব্যাপারটা আমি এখুনি পরীক্ষা করে দেখছি।’
লিভিংরুম থেকে বেরিয়ে নীচতলার স্টোররুমে ঢুকলেন ডক্টর, এখানে তিনি মাছ ধরার সরঞ্জামের সাথে কিছু আর্মসও রেখেছেন। গরমের সময় উইসকনসিনে শিকার তেমন কিছু মেলে না জেনেও আবরার একটা পিস্তল আর রাইফেল নিয়ে এসেছেন টার্গেট প্রাকটিসের জন্যে। সেই সাথে ব্রান্ড নিউ শটগানও রয়েছে। নতুন অস্ত্রটা যদি কোনও কাজ লাগানো যায়, এই ভেবে আনা।
পিস্তলটা নিলেন তিনি, একটা .৩৮ ক্যালিবারের স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন স্পেশালের সাথে একটা কার্ডবোর্ড রাইফেল টার্গেটও বের করলেন। তারপর বন্দুক নিয়ে চৌকোনা কার্ডবোর্ডটা লিভিংরুম এবং হলঘরের মাঝামাঝি মেঝের ওপর দাঁড় করিয়ে ফিরে গেলেন নিজের আসনে। বন্দুক কক করার শব্দে মাথা তুলল বেড়াল।
‘শোনো, বিল্লি,’ বললেন তিনি, ‘এসো, ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখ। তুমি যদি বাইরে যেতে চাও আত্মহত্যা করতে তা হলে কাজটা সহজ করে দিচ্ছি তোমার জন্যে। ওই দরজার কাছে যাও, টার্গেটের ওপর বসো, আমি তোমাকে গুলি করে মেরে ফেলি।’
বেড়ালটা ঘুমঘুম চোখে একবার পিটপিট করে তাকাল আবরারের দিকে, তারপর মাথা নামিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল-নাকি ঘুমের ভান করল?