‘ক্ষমতা! আমি ব্ল্যাক টেম্পলের কথা পড়েছি, পড়েছি সেই গভীর ধর্মবিশ্বাসের কথা যে ধর্মকে পরিচালনা করতেন পার্চমেন্টে উল্লিখিত প্রভুরা। তাঁরা জাদুটোনা করার মত সাধারণ সন্ন্যাসী ছিলেন না; তাঁরা এ ভূলোক ছেড়েও দ্যুলোকে বিচরণ করতেন। তাঁদের অভিশাপকে সবাই ভয় পেত, আশীর্বাদকে করত সম্মান। কেন? কারণ তাঁদের জ্ঞানভাণ্ডার অসীম ছিল বলে। বিশ্বাস কর পিটার, এই সমাধির মধ্যে আমরা যে গোপন তথ্যের খোঁজ পাব তা দিয়ে অর্ধেক পৃথিবীতে রাজত্ব করতে পারব। মৃত্যু-রশ্মি, তীব্র বিষ, প্রাচীন গ্রন্থ আর জাদুবিদ্যার সম্মিলিত শক্তি দিয়ে আবার অন্ধযুগের দেবতাদের পুনর্জন্ম ঘটাতে পারব। ভাব একবার ব্যাপারটা। এই ক্ষমতার অধিকারী যে কেউ গোটা দেশকে হাতের মুঠোয় পুরে রাখতে পারবে, পারবে শাসন করতে এবং তার শত্রুদের ধ্বংস করতেও সে এ জ্ঞান ব্যবহার করবে। তার থাকবে অজস্র ধনরত্ন, সম্পদের পাহাড়, বিলাস বৈভব, হাজার সিংহাসনের বিপুল সমারোহ!’
বাবা নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছে, ভাবল পিটার। ঝেড়ে দৌড় দেয়ার ইচ্ছে হলো। এই ভয়াল অন্ধকার জগৎ থেকে বেরিয়ে সুনীল আকাশ দেখার প্রচণ্ড তৃষ্ণা অনুভব করল সে, খাঁটি, তাজা হাওয়ায় বুক ভরে শ্বাস নেয়ার আকাঙ্ক্ষায় আইঢাই শুরু করল ফুসফুস। এই মৃত-শতাব্দীর ধুলাবালির কবল থেকে মুক্তি চায় সে। দৌড় দিয়েওছিল পিটার কিন্তু সার রোনাল্ড খপ করে ওর কাঁধ চেপে ধরলেন, টান দিয়ে ওকে ঘোরালেন তাঁর দিকে।
তুই দেখছি আমার কথা কিছুই বুঝতে পারিসনি।’ বললেন তিনি। ঘটে হলুদ পদার্থ থাকলে অবশ্য বুঝতি। যাকগে, তাতে কিছু যায় আসে না। আমি আমার মিশন সম্পর্কে নিশ্চিত। তুইও হবি। তবে আগে আমাকে প্রয়োজনীয় কাজগুলো সেরে ফেলতে হবে। এখন তোকে পার্চমেন্টের সেই অংশটা, যেটা আমি পড়ে শোনাইনি, তাতে কী লেখা ছিল, বলব।’ পিটারের মস্তিষ্কে যেন সতর্ক ঘণ্টি বেজে উঠল কে যেন বলতে লাগল পালাও-পালাও! কিন্তু সার রোনাল্ড ওকে শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে আছেন। পালাবার উপায় নেই। তাঁর গলা কাঁপছে।
‘যে অংশের কথা আমি বলছি তাতে লেখা ছিল কীভাবে এই মূর্তি পার হয়ে সমাধিতে ঢুকতে হবে। মূর্তির দিকে চেয়ে থেকে লাভ নেই, নতুন কিছু আবিষ্কার হবে না; আর এর মধ্যে গোপনীয়তা বলেও কিছু নেই, দেবতার এই শরীরে কোনও যন্ত্রাংশও নেই। মহাপ্রভু এবং তাঁর উপাসকরা এসব কাঁচা কাজ করতে যাননি। সমাধিতে ঢোকার রাস্তা একটাই-দেবতার শরীরের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করতে হবে।’ অ্যানুবিসের মুখোশের মত ভয়ঙ্করদর্শন চেহারাটার দিকে আবার তাকাল পিটার। শেয়াল মুখটাতে ধূর্ততার ছাপ সুস্পষ্ট নাকি এ স্রেফ আলোছায়ার খেলা?
‘কথাটা অদ্ভুত শোনালেও সত্যি।’ বলে চলেছেন সার রোনাল্ড। ‘তোর নিশ্চয়ই মনে আছে পার্চমেন্টে এই মূর্তিটিকে অন্য সবার থেকে আলাদা বলা হয়েছে? কিন্তু অ্যানুবিস কী করে পথপ্রদর্শক হলো আর এর গোপন আত্মার ব্যাপারটিই বা কী? পরের লাইনেই অবশ্য এ কথার জবাব আছে। মনে হয় মূর্তিটি একটি পিভট (Pivot)-এর ওপর ভর করে ঘুরতে পারে আর ওটার পেছনের একটা অংশ খুলে ফাঁকা হয়ে যায়। সংযোগ ঘটে সমাধির সঙ্গে। কিন্তু এটা তখনই সম্ভব হবে যখন মূর্তির মধ্যে জাগবে মনুষ্য সচেতনতা।’
আমরা আসলে সবাই পাগল, ভাবল পিটার। আমি, বাবা, প্রাচীন সন্ন্যাসীরা এমনকী এই মূর্তিটাও। সমস্ত অশুভ যেন এক গিটঠুতে বাঁধা। ‘এর অর্থ একটাই। আমি দেবতার দিকে তাকিয়ে নিজেকে সম্মোহিত করব। ততক্ষণ পর্যন্ত সমাহিত থাকব যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার আত্মা এই মূর্তির শরীরে প্রবেশ করে এবং সমাধিস্তম্ভের প্রবেশদ্বার খুলে যায়।’
ভয়ের ঠাণ্ডা একটা স্রোত যেন জমিয়ে দিল পিটারকে।
‘তবে এটাকে উদ্ভট কোনও চিন্তা ভেবে অবজ্ঞা করিস না। যোগীরা বিশ্বাস করেন এভাবে অন্যের শরীরে প্রবেশ করা সম্ভব। আত্মসম্মোহন সব জাতির মধ্যেই স্বীকৃত একটি বিষয়। আর সম্মোহনবিদ্যা একটি বৈজ্ঞানিক সত্য। হাজার বছরেরও আগে থেকে এই সত্যের চর্চা হয়ে আসছে। প্রাচীন সন্ন্যাসীরা সম্মোহনের ব্যাপারটি খুব ভাল জানতেন। আর আমিও এখন তাই করতে যাচ্ছি। নিজেকে সম্মোহন করব আমি এবং আমার আত্মা বা সচেতনতা মূর্তির মধ্যে ঢুকে যাবে। আর আমি তখনই শুধু সমাধিস্তম্ভ খুলতে পারব।’
‘কিন্তু ওই অভিশাপ!’ বিড়বিড় করে বলল পিটার। ‘অবিশ্বাসীদের সম্পর্কে ওতে কী বলা হয়েছে তুমি তো জানই যারা বিশ্বাস করে না যে প্রভু অ্যানুবিস এই সমাধিস্তম্ভের পথপ্রদর্শকই শুধু নয়, রক্ষাকর্তাও বটে। এই অবিশ্বাসীদের ওপর অভিশাপ নেমে আসার কথাও তো বলা হয়েছে। তার কী হবে?’
‘দূর দূর ওসব খেলো কথা।’ সার রোনাল্ড দৃঢ় গলায় বললেন। ‘সমাধি লুটেরাদের ভয় দেখাতে ওসব অভিশাপ-টভিশাপের কথা বলা হয়েছে। যা থাকুক কপালে ঝুঁকি আমি নেবই। তুই শুধু দেখ আমি কী করি। আমি যখন সম্মোহিত হয়ে পড়ব তখন মূর্তিটা নড়ে উঠবে এবং ওটার নীচের অংশটা খুলে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে তুই ভেতরে ঢুকে যাবি। তারপর আমাকে জোরে ঝাঁকুনি দিলেই আমি আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসব।
বাবার আদেশ অমান্য করতে পারল না পিটার! মশালটা উঁচু করে ধরল, আলো সরাসরি বিচ্ছুরিত হতে লাগল অ্যানুবিসের মুখের উপর। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল পিটার, দেখল বাবা শেয়াল দেবতার চোখে চোখ রেখেছেন। পাথুরে, ঠাণ্ডা দু’জোড়া চোখ